যখন চীনে করোনাভাইরাস দেখা দিলো তখন আমাদের দেশের ওয়াজিদের বলতে শোনা গেলো মুসলিম নিধনের কারণে চীনে আল্লাহর গজব পড়েছে। আল্লাহ তার সৈন্য কোরোনাভাইরাস রূপে পাঠিয়েছেন। তারপর তারা চীনের প্রেসিডেন্টকে মসজিদে ঢুকিয়ে নামাজ পর্যন্ত পড়িয়ে ছাড়লেন।
আর আমাদের দেশে ধর্মভিরু ধর্মান্ধ মুসলমানেরা বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করে বলতে লাগলো আল্লাহ চাইলে কি না পারেন, আল্লাহ মহান ।
তারপর যখন চীন থেকে কোরোনাভাইরাস ইতালী সহ বিশ্বের কিছু দেশে ছড়িয়ে পরতে শুরু করলো তখন সে সব ওয়াজিদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ালো কোয়ারেন্টাইন কিংবা সামাজিক দূরত্ব। তখন আমাদেরকে ওনারা কেন ইতালিতে ভাইরাস ছড়িয়ে পরলো তারও একটা ব্যখ্যা দিতে লাগলেন। আম জনতা সে ব্যাখ্যা থেকে যা বুঝলো সেটি হলো ইতালীর ওপরে আল্লাহ এই গজব অনেক পুরোনো হিসাব নিকাশ। আমজনতা বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো আল্লাহর কী লীলাখেলা বুঝা বড়ই দায়।
তারপর যখন করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্বে কোয়ারেন্টাইন কিংবা সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হলো তখন আমাদের দেশের ওয়াজিদের বুক ফাটিয়ে বলতে দেখা গেলো এই কোয়ারেন্টাইন কিংবা সামাজিক দূরত্বের কথা যা এখন এই অমুসলিমরা বলছে সেটি যেকোনো মহামারী মোকাবেলায় এই পদ্ধতি প্রয়োগের কথা আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে বলে গেছেন। ধর্মভিরু আর ধর্মান্ধ মুসলমানেরা মনে মনে বলতে লাগলো আল্লাহ মহান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আমরা নিরাপদে আছি এই গজবতো শুধু অমুসলিমদের জন্য।
তারপর এই ভাইরাস যখন মধ্যপ্রাচ্যে ছড়াতে শুরু করলো কাতার, কুয়েত, দুবাই, সৌদিআরব সহ অন্যান্য মুসলিম দেশে এই ভাইরাস মোকাবিলায় মসজিতে নামাজ না পরে নিজ নিজ ঘরে নামাজ আদায় করার জন্য উৎসাহিত করতে শুরু করলো। সৌদিআরবের মক্কা-মদিনায় সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো তা দেখে তো ধর্মভিরু আর ধর্মান্ধ মুসলমানের তো চোখ কপালে। দিনরাত লক্ষ লক্ষ মানুষের ইবাদতে মশগুল থাকা সেই কাবাশরীফে আজ সুনসান নীরবতা। এই দৃশ্য দেখে যেকোন মুসলমানেরই কলিজা কেঁপে উঠার কথা। কাবা শরীফ বন্ধ মানেই তো কিয়ামত, তাহলে কী কিয়ামত সন্নিকটে, ওয়াজিদেরও মুখ বন্ধ। আমজনতা তখন থানকুনির পাতা সংগ্রহে ব্যস্ত।
তারপর আসলো ইতালির মামুন মারুফের স্বপ্নের ব্যখ্যা 1.q7+6=13 থিওরী মাকড়সা আর কবুতরের বিশেষ অংশদিয়ে ঔষধ বানানোর ফর্মুলা। যে ফর্মুলার খবর পেয়ে স্বয়ং আমেরিকার গবেষকরা গামছা বেঁধে গবেষণায় নেমে পড়েছিলেন। ধর্মভিরু আর ধর্মান্ধ মুসলমান মনে মনে ভাবতে লাগলো আমরা ভয় পাই না আমাদের ঔষধ আছে।
তারপর যখন এই করোনা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরলো তখন এই মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করে বসে থাকা ধর্মভিরু আর ধর্মান্ধ মুসলমানেরা দিশেহারা। যে গজব আমাদের জন্য ছিলো না সেটি কেন আমাদের দেশে চলে আসলো। দেশে দোকানপাট, হোটেল, স্কুল-কলেজ, মসজিদ সহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয় বন্ধের ঘোষণা আসলো তখন আমরা চৌদ্দশ বছর আগে আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নির্দেশনা অনুযারী মহামারী মোকাবেলায় আমাদের সামাজিক দূরত্বের বজায় রাখার কথা ভুলে গেলাম। আর ভুলে যাওয়ারই তো কথা, যে গজব আমাদের জন্য আসেনি সে গজবকে ভয় পাবার তো কিছু নেই। এই ভাইরাস যাদের ধরবে তার অভিশপ্ত, আল্লাহর তাদের জন্য এই করোনা নামক এই গজব পাঠিয়েছেন।
এখন আসি আসল কথায়, আমরা যেমন সরকারের করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলি ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ওয়াজিদের আমাদের দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষদের বিগত দু মাসে এই ভাইরাস মোকাবেলায় মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারি। তারা চাইলে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলামানদের করোনা মোকাবেলায় সঠিক পন্থায় মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে নিতে পারতেন। তাদের হাতে সেই শক্তি সামর্থ্য ও সময় যথেষ্ট পরিমানে ছিলো। যদি আজ থেকে ১০ বছর পিছনে থাকাই তাহলে দেখবেন ১০ বছরের আগের ওয়াজের শ্রোতা আর এখনকার শ্রোতা এক নয়। যেমন কিছু সংখ্যক ওয়াজিদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে ঠিক তেমনি শ্রোতাদের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে একজন বক্তার ওয়াজ আজ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে, আগের এক নির্দিষ্ট শ্রেণীর ওয়াজের শ্রোতার গণ্ডি পেরিয়ে একজন বক্তার ওয়াজ সবার কাছে সহজে পৌঁছে যাচ্ছে তাই শ্রোতার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইদানিং অনেক বক্তাদেরই ওয়াজের মাঠে মাইক হাতে একজন বক্তার বিরুদ্ধে আরেকজনকে দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
তার একটি সহজ কারণ হলো অনেক বক্তারাই আগে যারা মাইক হাতে ওয়াজে ভিত্তিহীন বিভিন্ন কিচ্ছা কাহিনী শুনিয়েছেন, কঠিন ভাবে মানুষের কাছে ইসলাম কে তুলে ধরেছেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম বলে জিহাদ জিহাদ বলে মুখে ফেনা তুলেছেন, শুধুমাত্র নারীদেরই পর্দার কথা বলে সকল পাপ কাজের সমাধান বুঝিয়েছেন। ইসলাম নারীদের মর্যাদা বাড়িয়েছে দিয়েছে বলে শুধুমাত্র স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্যের কথা শুনিয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ নিজের ভ্রমন কাহিনী বাপ-দাদার সহ নিজের বায়োপিক বলে বেরিয়েছেন এই সময়ে এসে তাদের ওয়াজের মাঠে ঠিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় ইসলামিক বিশ্যবিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসা ইসলামিক স্কলারও রয়েছে। নতুন বক্তাদের মধ্যে যখন অনেকেই পুরাতন প্রথা ভেঙ্গে তথাকথিত কিচ্ছা কাহিনী বাদ দিয়ে সহজ ভাবে ইসলামকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে লাগলেন তখন সাধারণ মানুষের মনে সংশয় দেখা দিতে লাগলো। সাধারণ মানুষের আজ হয-বরল অবস্থা, বাবা দাদার আমল থেকে যা শুনে আসলাম আজ নতুন এসব আবার কি শুনছি। মানুষ ধর্মভীরু না হয়ে ধর্মান্ধ হয়ে পড়েছে।
মানুষ আজ আল্লাহ কে ভয় না করে করোনাভাইরাসকে কে ভয় করতে শুরু করেছে। কারণ সাধারণ মানুষ জানে না যে জীবন্ত অবস্থায় বেহেস্তের সু সংবাদ পাওয়া কয়েকজন সাহাবীদের মধ্যে একজন এই মহামারীতেই মারা গিয়েছিলেন। মানুষ জানে না যে আল্লাহ তার বান্দার জন্য ইসলামকে কঠিন করে নয় সহজ করে দিয়েছেন। মানুষ জানে না যে পর্দা শুধু নারীদের জন্য নয়, পুরুষদেরও দেয়া হয়েছে। মানুষ জানে না যে, একবার ইনশাআল্লাহ না বলার কারণে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে ১৭ দিন কোন ওহী আসেনি। মানুষ জানে না যে আমরা কাবা ঘরের নয় আল্লাহর ইবাদত করি। মানুষ জানে না যে আল্লাহকে মসজিদে খোঁজার আগে অন্তরে খোঁজে নিতে হয়।
সিলেটের সুনামগঞ্জে করোনা আক্রান্ত সন্ধেহে এক মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনের জন্য তার পরিবারকে মসজিদের লাশ বহনের খাটিয়া পর্যন্ত দেয়া হয়নি। পরে ওই মৃতব্যক্তির দুই ভাই আর বাবা কাঁধে করে লাশ বহন করে দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। আজ বাংলাদেশে কেন করনাভাইরাস? করোনা আক্রান্ত পরিবার গুলি কেন আজ সামাজিক ভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে? কেন একজন মৃত ব্যক্তির দাফনের জন্য মসজিদের লাশ খাটিয়া ব্যবহার করতে দেয়া হল না? ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ভয়ে সন্তান তার অসুস্তহ মা বাবা কে, স্ত্রী তার স্বামীকে ঘর থেক ফেলে দিচ্ছে। মৃত ব্যক্তির দাফন কাফনের জন্য কেন কোন ইমাম পাওয়া যাচ্ছে না? এর জবাব কি আছে আমাদের দেশের ইসলামিক চিন্তাবিদের কাছে?
বিঃদ্রঃ আমার লিখাটি কাউকে আঘাত কিংবা দোষারোপ করার জন্য নয়। তারপর ও আপনাদের মতামত ও ভিন্নমত পোষণের জন্য অগ্রিম কৃতজ্ঞতা।
লেখকঃ তফাজ্জুল তপু
বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য