যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে ইসরাইল ‘রেড লাইন’ টানার যে চেষ্টা করছে তা হৈ চৈ ছাড়া আর কিছু নয়। ওবামা স্পষ্টতই বলেছেন, তবে তিনি ইসরাইলের ওই ধরনের শোরগোল উপেক্ষা করার চেষ্টা করছেন।
রোববার সিবিএস নিউজ চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাতকারে ওবামা আরো বলেছেন, বিষয়টি আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত, কাজেই তিনি এ ব্যাপারে মার্কিন জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। এর আগে ইসরাইল ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ২০ মাত্রায় বেঁধে দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে দেশটিকে পারমাণবিক শক্তি অর্জনে একটি ‘রেড লাইন’ আরোপের আহবান জানানোর পর ইরান বলেছে, তারা কখনই তার চেয়ে বেশি মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রয়োজন মনে করছেন না।তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষেকরা বলছেন, তেহরানে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন হবার পর মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ইসরাইলের একমুখী নীতির পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। ইরানের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে চিন্তা করছে এবং তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের তেহরান ঘুরে আসার পর।বিশেষ করে মিশরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি ইরানের সাথে চমৎকার সম্পর্ক গড়তে চাচ্ছেন যা সিরিয়া সংকট নিরসনে কাজে লাগতে পারে। একই সাথে আরব বসন্ত শুরু হবার পর মধ্যপ্রাচ্যের যে সব দেশগুলোতে রাজতন্ত্র রয়েছে সেসব দেশের শাসক নতুন এই সংকটের একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে পারে নি যা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য কৌশলকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। একই সাথে ইসরাইলের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট তীব্র হওয়ায় এবং পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক মন্দায় নতুন করে আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে বলেই বিশ্লেষকদের অভিমত। এজন্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলছেন, ‘আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মার্কিন জনগণের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই শুধু বিবেচনা করি।
এর বাইরের কোন হৈ চৈ-এ আমি কান দেবো না। কিন্তু এতদিন ইসরাইলের অভিপ্রায় আন্তর্জাতিক নীতি বা মধ্যপ্রাচ্য কৌশলে মার্কিন ইচ্ছে হিসেবে প্রকাশ পেত। অথবা নভেম্বরে নির্বাচনকে সামনে রেখে মুসলমানদের ভোট বা যারা অহেতুক সামরিক শক্তি কাজে লাগানো বা যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার বিরোধীতা করছেন সেই সব ভোটারদের মন জয় করতে ওবামা চেষ্টা করছেন বলেও বিশ্লেষকরা অনুমান করছেন। ইরানের বেসামরিক পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চলতি মাসের গোড়ার দিকে আমেরিকা ও ইসরাইলের মধ্যে টানাপড়েন তুঙ্গে ওঠে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য এখনো ‘সময় ও সুযোগ’ আছে বলে হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জে কার্নি ঘোষণা দেয়ার পর ওয়াশিংটন ও তেলআবিবের মধ্যে ওই টানাপড়েন তৈরি হয়। এরপর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত ২ সেপ্টেম্বর ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে ‘পরিস্কার রেড লাইন’ নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহবান জানান। দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো বরাবরই ইরানের সাথে আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সংকট সুরাহা করার পক্ষপাতি। কিন্তু ইসরাইল ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপাতে চায় বলে তেহরান কম যায় না। ইসরাইলকে মোকাবেলার জন্যে ইরান চীন, রাশিয়া, ভারত ছাড়াও ল্যাটিন আমেরিকার দেশ বা ইউরোপের অনেক দেশের সাথে চমৎকার অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সামরিক সহযোগিতা গড়ে তুলেছে।
এছাড়া ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখলে কোনো দেশ যদি মার্কিন ভীত এড়াতে পারে তাহলে তাকে জ্বালানি চাহিদা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। আর ইরানের বিরুদ্ধে একের পর এক অবরোধ যে অকার্যকর হয়ে পড়েছে তা পশ্চিমা দেশগুলোই এখন সবচেয়ে জোর গলায় বলছে। এসব বিষয় লক্ষ্য রেখে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গত ১০ সেপ্টেম্বর বলেন, কূটনৈতিক উপায়ে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধানের যে চেষ্টা চলছে তাতে ওয়াশিংটন কোন ‘চূড়ান্ত সময়সীমা’ ঠিক করবে না। তবে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করে নিজেই একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের অধিষ্ঠাতা থাকবে সে সময় বুঝি ফুরিয়ে এসেছে। এর কারণ ইরান সামরিক শক্তিতে অনেক দূর এগিয়েছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর উপপ্রধান কমান্ডার হোসাইন সালামি বলেছেন, তার দেশের কৌশলগত নীতি প্রতিরক্ষামূলক, কিন্তু তার রণ-কৌশলগুলো আক্রমণাত্মক। আর শত্রুদের প্রধান স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যগুলো সনাক্ত করেছি। ইরান ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ সব ধরনের আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি আয়ত্ত করে তা ওই অঞ্চলে তার প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর আওতায় রেখেছে।ইরানের ‘পেহপদ’ নামের পাইলটবিহীন গোয়েন্দা বিমানগুলো একটানা ২৪ ঘণ্টা ধরে আকাশে উড়তে সক্ষম এবং সেগুলো হাজার হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে।
এছাড়া জলে নামছে সাবমেরিন ও ডেস্ট্রয়ার আর তার জন্যে ইরানকে অন্য কোনো দেশের মুখাপেক্ষী থাকতে হচ্ছে না। অর্থাৎ জ্বালানি রপ্তানির পর যে বিলিয়ন বিলিয়ন পেট্রোডলার হাতে পাওয়া গেছে তা অন্যান্য আরব দেশের শেখদের মত বিলাসিতা ভাসিয়ে না দিয়ে প্রযুক্তি ও সামরিক সক্ষমতা ভালই অর্জন করেছে দেশটি। এর আগে হিজবুল্লাহ প্রধান সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহ বলেছিলেন, ইরান গত ৩২ বছর ধরে ইসরাইলকে ধ্বংস করার ঐতিহাসিক সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছে। মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ক চাচ্ছে নতুন করে খেলাফত প্রতিষ্ঠার। সিরিয়ার এমন অভিযোগ থাকলেও ওই খেলাফত প্রতিষ্ঠায় আরব দেশগুলোর সায় আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এধরনের কূটনৈতিক দোলাচলে মিশর, ইরান ও তুরস্কের মধ্যে একটা অভিন্ন নীতি পরিস্কার হয়ে উঠেছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি বলেছেন, সিরিয়ার চলমান সংকট নিরসনের পথ খুঁজে বের করার জন্য ইরানের সঙ্গে তার দেশের সম্পর্ক জোরদার করা প্রয়োজন। তিনি এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে আরো বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং সিরিয়া সংকট নিরসনে দেশটি কার্যকর ও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে। সিরিয়া সংক্রান্ত আলোচনা থেকে ইরানকে বাদ দেয়ার যে নীতি পশ্চিমা দেশগুলো নিয়েছে তা নাকচ করে দিয়ে প্রেসিডেন্ট মুরসি বলেন, এ ধরনের আলোচনায় ইরানের উপস্থিতি সমস্যা সৃষ্টির পরিবর্তে বরং সমস্যা সমাধানে সহায়তা করবে। একটু পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের ইসরাইলপন্থী নীতির কারণে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর তেহরান-কায়রো সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকও মুসলিম বিশ্বের প্রধান শত্রু ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একই ধারা বজায় রাখায় ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো অবকাশ সৃষ্টি হয়নি। অবশ্য তখন সবার ভীতি ছিল ইরানি বিপ্লব রপ্তানি নিয়ে। কিন্তু গত বছর গণবিপ্লবের মধ্যদিয়ে স্বৈরশাসক মুবারকের পতন ঘটলে পরিস্থিতি বদলে যায়। মিশরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মোহাম্মাদ মুরসি। তিনি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং পশ্চিমাদের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ইরানে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যামের ষোড়শ শীর্ষ সম্মলনে যোগ দেন।
মোহাম্মাদ মুরসি তার সাক্ষাতকারে আরো বলেন, ইরানের সঙ্গে মিশরের বিশেষ কোনো সমস্যা নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিশরের যে রকম সম্পর্ক বিরাজ করছে একই ধরনের সম্পর্ক রয়েছে ইরানের সঙ্গেও। এখন মধ্যপ্রাচ্যে এধরনের পরিবর্তন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় এমন কৌশল নেবে তাতে যদি ইসরাইল চটে যায় তাহলে কার কি যায় আসে।
অনলাইন ডেস্ক