ইন্টারনেট কাজে লাগিয়ে ইরানে একের পর এক চালানো হচ্ছে সাইবার হামলা। দেশটির পরমাণু কর্মকাণ্ড পিছিয়ে দিতেই এ হামলার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় পারমাণবিক কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্ন করতে দেশটি ইন্টারনেট থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে।
ইরানের বেশ কয়েক পদস্থ কর্মকর্তা মার্কেটওয়াচ ওয়েবসাইটকে এ ইঙ্গিত দিয়েছেন। একের পর এক সাইবার হামলার শিকার হওয়ায় তিতিবিরক্ত ইরানের তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী রেজা তাকিপুর সম্প্রতি জানান, বৈশ্বিক ইন্টারনেটব্যবস্থা বিশ্বস্ত নয়। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হবে বলেও তিনি জানান।
এ সম্পর্কে পেনিসিলভ্যানিয়ার অ্যানেবার্গ স্কুল অব কমিউনিকেশনের ইরান মিডিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক মাহমুদ এনায়াত সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেন, পশ্চিমারা ইরানের ওপর সরাসরি হামলা চালাবে— এ ভয় এখন আর দেশটি পায় না। তবে তারা মনে করে, এখনো পশ্চিমারা ইরানের দখল নিতে চায় এবং এ জন্য তারা ব্যবহার করবে ইন্টারনেট।
সাইবার হামলার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ভাইরাস ছড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি দেশটিতে ছাড়া হয়েছে ফ্লেইম ভাইরাস। এর আগে ছাড়া হয়েছিল স্টাক্সনেট। এ রকম আরও প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান ইরানের আরেক উচ্চপর্যায়ের নেতা হামিদ শাহিরাই। গত মার্চে তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমরা ৬৫০টি ওয়েবসাইট চিহ্নিত করেছি, যা আমাদের দেশের ক্ষতি করার জন্য বানানো হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি ওয়েবসাইট সরাসরি আমাদের বিরুদ্ধে লেগেছে এবং বাকিগুলোয় পশ্চিমাদের সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করে আমাদের দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে।’
ইন্টারনেট বন্ধ করার পাশাপাশি দেশের ভেতরে নিজস্ব ইন্ট্রানেট চালুর ব্যবস্থাও ভাবছে ইরান। এর মাধ্যমে ইরানের জনগণ নিজেদের মধ্যে কম্পিউটারের মাধ্যমে যুক্ত থাকলেও বাইরের বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকবে।
ইন্টারনেট বন্ধ করার বিষয়ে ইরান যে হুমকি দিচ্ছে, তা আসলেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে ওয়ার্ল্ডওয়াইডওয়েব প্রকল্পে কাজ করা ও মাইক্রোসফটের সাবেক কর্মী ক্রেইগ ল্যাবোভিটজ বলেন, ‘এটি খুবই সম্ভব। কারণ দিনশেষে ইন্টারনেট কেবল তারের মাধ্যমে সংযুক্ত একটি বিষয়। তারটি বিচ্ছিন্ন করা হলেই এটি বিচ্ছিন্ন করে দেয়া সম্ভব। তিনি আরও বলেন, এটি বিচ্ছিন্ন করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। কাজের সূত্রে আমি নিজেও বেশ কয়েকবার সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি।’
ল্যাবোভিটজ আরও বলেন, কাগজে-কলমে এটি করা খুব সহজ হলেও বাস্তবে এটি একটু হলেও কঠিন। কারণ শুধু ইন্টারনেট বন্ধ করলেই চলবে না, এর সঙ্গে জনগণকে বিকল্প সেবা দেয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এটি করাটা ইরান সরকারের জন্য কঠিন হবে। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জটি কারিগরিভাবে কঠিন না হলেও সামাজিক ও আর্থিকভাবে কঠিন। ইরান নিজেকে যদি ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, তাহলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
ইলেকট্রনিক ফ্রান্টিয়ার ফাউন্ডেশনের কর্মী ইভা গ্যালপারিনের মতে, এটি করলে ইরানই বিপদে পড়বে। তিনি বলেন, এখন সবকিছুই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত। তাই এটি থেকে পিছিয়ে পড়লে ইরান পিছিয়ে পড়বে।তার ভাষায়, এটি পুরোপুরি অদ্ভুত ভাবনা এবং এটি করাটা বাস্তবসম্মত হবে না।
নিজস্ব ইন্ট্রানেট ব্যবস্থা গড়ে তুলতেও ইরানকে অনেক বেগ পেতে হবে বলে মনে করেন তিনি। তার ভাষায়, এটা ঠিক, ইরান সরকারের দেশের সব আইএসপির ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু নতুন করে একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তাদের বিপুল অর্থ ব্যয় হবে। এ ছাড়া কেবল ইন্টারনেট বন্ধ করলেই চলবে না, জনপ্রিয় ইন্টারনেট সাইটগুলোর বিকল্প সাইটও চালু করতে হবে ইরানকে। তাদের নতুন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব চালু করতে হবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকিং করার ক্ষেত্রেও তাদের ইন্টারনেটের প্রয়োজন হবে।
মাহমুদ এনায়েত বলেন, ইরানের ২০ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে এবং তাদের জন্য ইন্ট্রানেট ব্যবস্থা তৈরি করতে চাইলে ইরানকে দুটি কাজ করতে হবে। তাদের নতুন যন্ত্রাংশ আনতে হবে, যা বর্তমানে সম্ভব নয়। কারণ ইরানের ওপর এখন সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ জন্য তারা প্রয়োজনীয় সার্ভার কিনতে পারবে না। দ্বিতীয়টি হলো, এত বড় একটি বিষয় নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা তাদের নেই।
নতুন ওয়েবসাইট চালু করা হলেও সেগুলো কতটুকু জনপ্রিয় হবে, তা নিয়েও সন্দিহান ইভা। তিনি বলেন, দেশটিতে ইউটিউবের আদলে অ্যাপারাত নামের একটি ওয়েবসাইট রয়েছে। কিন্তু সেটি মোটেও জনপ্রিয় নয়।ইভা আরও বলেন, একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেয়ে অনেক কঠিন জি-মেইলের মতো একটি ব্যবস্থা চালু করা। এর আগে ইরান যখন কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ করেছিল, তখন এক এমপি এর প্রতিবাদ করেছিল।
ইন্টারনেট ছাড়া তার থাকবে কীভাবে? আয়াতুল্লাহ খামেনিরই তো ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
অনলাইন ডেস্ক