সিনাইয়ে ৫ আগস্ট মিসরীয় সীমান্ত রক্ষীদের ওপর হামলা হলো। ১৬ কর্মকর্তা ও সৈনিক মারা গেলেন। হামলাকারীরা সনাক্ত হয়নি। ঘটনা সরকারি তদন্তাধীন রয়েছে। বহু মিসরীয়ের ধারণা, হামলা ইসরাইল চালায়। গাজাভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোকেও অনেকে হামলাকারী মনে করছেন। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হামলায় লাভবান হচ্ছে কারা সেদিকে নজর দিয়েছেন। তারা বলছেন, হামাস জঙ্গীদের হামলায় জড়িত হওয়ার কোনো স্বার্থ নেই। ইসরাইলী গোয়েন্দাদের সিনাই হত্যাকান্ডের জন্য তারা দায়ী করছেন।

ঘটে চলা একের পর এক পরস্পর সম্পৃক্ত ঘটনায় অঞ্চলের পরিস্থিতি এতোই জটিল যে, একক কোনো ঘটনায় বিচ্ছিন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপে ঘটনার হেতু বা হোতা চিহ্নিত করার চেষ্টা সফল হতে পারে না-এমনটিও মনে করেন বহু ভাষ্যকার।

আরব বিশ্বে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা এবং রাজনীতিতে এদের প্রভাব ক্রমে বাড়ছে। ইসরাইল নিজেকে বিপদগ্রস্ত মনে করছে আগের চেয়ে বেশি। অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জয়ী হয়ে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো বহুদিন পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পরবর্তীতে জবরদখলকার ইসরাইলের হম্বিতম্বি আগের মতোই বরদাস্ত করে নেবে না, সহজেই তা অনুমেয়। আরব দেশগুলোয় তৎপর ইসলামপন্থীদের নিজেদের মধ্যকার ঐক্যচেষ্টা ইসরাইলের ঘুম হারাম করবে-এটা খুবই স্বাভাবিক। মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা মোহাম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন- অর্থাৎ রাষ্ট্রের শাসক-পরিচালকের আসনে আসীন হয়েছেন। গাজায় ক্ষমতাসীন রয়েছে হামাস। পাশের অবস্থানগুলোয় এমন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ইসরাইল উৎকণ্ঠাহীন থাকতে পারে না। নিজের দেশের উপকণ্ঠে শত্রুর এমন ভয়ঙ্কর আয়োজনে ইসরাইলের পক্ষে নিশ্চুপ থাকা সম্ভব নয়, কারণ ইসরাইল দীর্ঘ মেয়াদে বোঝে, এই আয়োজন তার রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বকে ধরে টান দেবে।

সিনাইয়ে হামলা ও হত্যাকান্ডের জন্য ইসরাইলকেই দায়ী মনে করছেন বহু ভাষ্যকার। মিসরীয় ব্রিগেডিয়ার ও রণকৌশল বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সাফওয়াত আল জাইয়াত প্রসঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, হামলার মাত্র ক'ঘন্টা আগে তাদের কার্স আবু সালেম ক্রসিং ইসরাইল বন্ধ করে দিল কোন্ কারণে? অন্য ভাষ্যকাররা আরও চাঞ্চল্যকর যে তথ্য তুলে ধরেছেন, তাতে দেখা যায়, ইসরাইলী ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল কাউন্টার টেরোরিজম ব্যুরো' সিনাইয়ে অবকাশ যাপনরত ইসরাইলীদের হামলা হওয়ার তিন দিন আগেই অবিলম্বে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জরুরি আহবান জানাচ্ছে। কারণটা কি?

ঘটনার তদন্ত হওয়ার আগেই এবং হামলা হওয়ার পরপরই তিনটি গোষ্ঠীকে অভিযুক্ত করে ইসরাইলী কর্মকর্তারা বিবৃতি দিতে শুরু করলেন। ইসরাইলী সামরিক মুখপাত্র নতুন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী শূরা মুজাহিদীন কাউন্সিলের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুললো। কিন্তু গোষ্ঠীটি একটি বিবৃতি জারির মাধ্যমে অভিযোগ খারিজ করে। এর মধ্যে ইসরাইলী গোয়েন্দা ওয়েবসাইট ডিইবিকেএ ফাইল জানায়, ইসরাইলী সামরিক বিভাগ তাদেরকে দেয়া এক বক্তব্যে আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট সিনাই সালাফিপন্থী বেদুইনদের হামলায় জড়িত বলে দাবি করেছে। লক্ষণীয়, ইরাকে ও আফগানিস্তানে হামলায় জড়িত বলে বিবৃতি আল কায়েদা এ পর্যন্ত ইসরাইলে বা মিসর সীমান্তে হামলা চালিয়েছে বলে শোনা না গেলেও এখন বলা হচ্ছে, তারাই সিনাই হামলায় জড়িত ছিল। ঘটনা যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে হবে, সত্যিই দুর্দিন ইসরাইলের জন্য ঘনিয়ে এসেছে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন রাষ্ট্রদূত টুইটারে তার এক বক্তব্যে দাবি করেছেন, সিনাইয়ে হামলা চালিয়েছে ইরান সমর্থিত সন্ত্রাসীরা এবং তার মতে ইসরাইলী বেসামরিক লোকজনও এদের হামলা থেকে এখন আর সুরক্ষিত থাকতে পারবে না।

মোট কথা ইসরাইলী অভিযোগের সারবস্তু হচ্ছে- ইরানী, ফিলিস্তিনী ও মিসরীয় ইসলামপন্থী এবং আল-কায়েদা সবাই একযোগে ময়দানে নেমে গেছে মিসর ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে একমাত্র সিরিয়ায় ক্ষমতাসীন আসাদ প্রশাসনকে সুরক্ষা পৌছানোর উদ্দেশ্যেও। কিন্তু ইসরাইলের তোলা অভিযোগগুলোকে মিসরীয় সংবাদ মাধ্যম আমলে নেয়নি। সেখানে বরং বলা হচ্ছে ইসরাইল হামলায় জড়িত থাকতে পারে।

এক বছর আগে ছ'জন মিসরীয় সৈন্যকে ইসরাইল হত্যা করে ও তাদের লাশ সরিয়ে ফেলে। ভুলে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে বলে ইসরাইল পরে স্বীকার করলেও মিসরীয় জনগণের ক্ষোভ প্রশমন করা সম্ভব হয়নি- তারা কায়রোয় ইসরাইলী দূতাবাসে হামলা চালায়। ক্ষোভে-প্রতিবাদে ও প্রতিশোধের দাবিতে সারা মিসর উন্মত্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু পাশাপাশি লক্ষ্য করা যায়, মিসরীয় সেনাবাহিনী প্রতিরোধ নেবে বলে কথা দিলেও পরে কথা রাখেনি। মিসরীয় সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণও প্রকাশ পায়নি। আল-জাজিরা খবর দেয় পরে ইসরাইল লাশগুলো ফেরত দিলেও সেগুলোকে পুড়িয়ে এমন বিকৃত করে দেয়া হয়েছিল যে, লাশগুলোর ময়নাতদন্ত করে হত্যার কোনো ক্লু বের করা মিসরীয়দের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। লক্ষ্য করা যাচ্ছে সিনাইয়ের হত্যাকান্ডকে ঘিরে বিবৃতি ও অভিযোগগুলো এমন একটি লক্ষ্যে সাজিয়ে পরিচালিত করা হচ্ছে যার উদ্দেশ্যে ও কাম্য হলো মিসরীয় প্রেসিডেন্ট মুরসি মিসর সীমান্তে দুষ্কর্ম বন্ধে যত্নবান হবেন- অর্থাৎ গাজার সঙ্গে সুড়ঙ্গ সংযোগ বন্ধ করবেন তথা সব রকমের তথাকাথিত জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বদেশে শক্তিশালী ও শান্তিবাদী প্রেসিডেন্টরূপে আত্মপ্রকাশ করবেন। অন্যদিকে মিসরীয় জনগণের দাবিকে সম্মান জানিয়ে মিসরীয় প্রেসিডেন্টের মান রক্ষার্থে আবার ক্যাম্প-ডেভিড সমঝোতা বাস্তবায়নে ইসরাইলও এগিয়ে আসবে। ভাষ্যকারদের প্রশ্ন হচ্ছে- অন্তরালে তৈরি এই নীলনকশার নির্বিঘ্ন বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব হতে পারবে কি?

অনলাইন ডেস্ক