ইউরো অঞ্চলের সংকটের তিন বছর হতে চললেও ইউরোপের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ জার্মানির অর্থনীতি এ পর্যন্ত স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে জার্মানিতে বিভিন্ন খাত নিয়ে পরিচালিত জরিপে নেতিবাচক ফলাফল আসছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়বে জার্মানি। গত শুক্রবার দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ আভাস দেয়। খবর চায়না ডেইলির। সম্প্রতি দেখা যায়, দেশটির উৎপাদন খাত, শিল্পোৎপাদন আমদানি ও রফতানি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। সেই সঙ্গে ইউরো অঞ্চলের ঋণসংকটের কারণে দেশটি প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
গত শুক্রবার প্রকাশিত বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রণালয় জানায়, কয়েক মাস ধরে নেতিবাচক ফল প্রকাশের কারণে ব্যবসায় আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়ায় জার্মানির অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ছে। আগামী মঙ্গলবার দেশটির দ্বিতীয় প্রান্তিকের জিডিপির ফল প্রকাশের কথা রয়েছে। যেখানে জিডিপি ধীরগতিতে অর্থাৎ দশমিক ২ শতাংশে প্রসারিত হয়েছে। ফলে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে দেশটির অর্থনীতি মন্দায় পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
কমার্জ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জর্জ ক্রেমার বলেন, জার্মানির অর্থনীতি মন্দার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় তৃতীয় প্রান্তিকে দেশটির অর্থনীতি আরও সংকুচিত হবে। ইউরো অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মতো ভয়াবহ অবস্থা জার্মানির অর্থনীতিতে বিরাজ না করলেও এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি দেশটি। বিশেষ করে চীনের প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি অব্যাহত থাকায় এর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
জার্মানির অর্থনীতি মূলত রফতানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ইউরো অঞ্চলের ঋণসংকটের কারণে এর রফতানিকারক দেশগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রফতানি করা এসব পণ্যের ৪০ শতাংশ সরবরাহ করা হয় একক মুদ্রার দেশগুলোয়। আর বাকি ৬০ শতাংশ সরবরাহ করা হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয়।
চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশটির বেকারত্ব দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে। এ ছাড়া সরকারি খাত ও উৎপাদন শিল্পে বেতন বাড়ানো হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। মূলত অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর জন্য এ খাতে বেতন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু দেশটির খুচরা বিক্রির পরিমাণ কমে গেছে বলে জানিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। গত মাসে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান মেট্রোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, খুচরা বিক্রির অবস্থা ভালো নয়। এ ছাড়া ঋণসংকটের কারণে অন্যান্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা জনগণের ব্যয়কে নিরুতৎসাহিত করছে।
এ প্রসঙ্গে হুন্দাইয়ের জার্মানি শাখার প্রধান মার্কাস শ্রেইক বলেন, ‘২০১২ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিক্রির পরিমাণ কমে যাবে। কারণ ক্রেতারা এখন ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক। বর্তমানে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। এ কারণে আসন্ন সংকটকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।’
বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রচারমাধ্যম এআরডি চলতি মাসে জার্মানির অর্থনীতি বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৩ শতাংশ জার্মান মনে করেন অর্থনীতি সন্তোষজনক অবস্থায় ফিরে আসবে। মূলত শ্রমবাজারের ইতিবাচক অবস্থানের কারণে এমনটা মনে করছেন তারা। গত শুক্রবার প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, ইউরোপে গড় ২২ দশমিক ৬ শতাংশ বেকারত্বের তুলনায় জুনে দেশটিতে তরুণ বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯। ফলে ছয় বছর ধরে কর্মসংস্থান খাতে যে দুর্দশা বিরাজ করছিল, তার অবসান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত চার মাসের তুলনায় দেশটিতে ঋতুভিত্তিক বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েছে বলে জরিপে দেখানো হয়। এ ছাড়া দেশটির বড় কোম্পানিগুলোসহ ডাচ ব্যাংক, জ্বালানি প্রতিষ্ঠান আরডব্লিউই ও স্টিল সরবরাহকারী ক্লোকনার কয়েক হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা জানিয়েছে। তবে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন চলতি অর্থনৈতিক অবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আবার এদের মধ্যে অনেকেই আসছে বছরে দেশটির অর্থনীতি আরও খারাপের দিকে যাবে বলে মত দিয়েছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৪ শতাংশ মনে করেন, আসছে সময়ে ঋণসংকট আরও ঘনীভূত হবে।
গোটা ইউরোপে যে সংকট বিরাজ করছে সেখানে দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে জার্মানি কীভাবে সহায়তা দেবে তার উত্তর পাওয়া যায়নি। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফাঙ্কোয়েস হোলান্দ যৌথ এক বিবৃতিতে ইউরো অঞ্চলকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হবে গত মাসে জানান। কিন্তু অধিকাংশ জার্মান এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। জার্মান কনফেডারেশন অব স্কিল্ড ক্রাফটসের প্রেসিডেন্ট ওট্টো কেঞ্জলার বলেন, ব্যয় কর্তন ছাড়া একক মুদ্রার দেশগুলোয় স্থিতিশলীতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
অর্থনীতিতে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করলেও তা মার্কেল ও তার পার্টির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন এমনিড পোলিং গ্রুপের প্রধান ক্লাউস পিটার স্কপনার। কিন্তু গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল ও স্পেনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে।
বনিবার্তার সৌজন্যে