বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন ২০০০ সালে। তার বাবাও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বাশার আসাদ চোখের রোগ বিষয়ে বৃটেনে পড়াশোনা করেন এবং ইন্টারনেট সম্বন্ধে দক্ষ ব্যক্তি। সিরিয়ানরা ভাবলেন বাশার তার বাবার থেকে ভিন্ন ব্যক্তি হিসেবে দেখা দিবেন।

আলাভিদের পাহাড়ী গ্রাম কারদাহায় একটি কুঁড়ে ঘরে জন্ম হয়েছিল বাবা হাফেজ আসাদের। তখন সিরিয়ায় চলছিল উপনিবেশবাদী ফরাসীদের বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রাম।

প্রেসিডেন্ট পদের শপথ নেয়ার সময় যে ভাষণ বাশার আসাদ দেন, জনগণের তাকে ঘিরে আশাবাদ তাতে আরো প্রাণবন্তু হয়। দেশে রাজনৈতিক ও আর্থিক সংস্কার তিনি নিয়ে আসবেন দাবী করেন। তিনি বলেন, দেশে নজিরবিহীন উন্নয়ন তিনি ঘটাবেন। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মের বহুমঞ্চ দেশে গজিয়ে ওঠে। দামেস্ক স্প্রিং আখ্যা পায় কার্যক্রমগুলো। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণ পায় বাশার আসাদ তার বাবার থেকে পৃথক কিছু নন। চলাফেরায় নিজেকে জনগণের একজন হিসেবে দেখতে চান বাশার। কিন্তু সিরীয় বিপ্লবের মুখে পড়ে, দেখা গেলো নিজের গণশত্রুর মূর্তি বাশার মেলে ধরলেন অবলীলায়। দেশে ও বিদেশে তার শামনামলে সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নষ্ট হতে শুরু করে।

বাশারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম কৃতিত্বটি হচ্ছে-দুর্নীতি ও কুশাসন তার আমলে এমন ভাবে বাড়ে যে, পল্লী গ্রামের লোকজনও সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নামে। আধুনিক সিরিয়ার ইতিহাসে এমন ঘটনা এটিই প্রথম। বাশার ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক মৈত্রী গড়ে তোলেন ইরান ও হিযবুল্লার সঙ্গে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংঘাতের মধ্যস্থলে সিরিয়াকে আরেকবার এসে খাড়া হতে হয় বাশার সাহেবের শাসনকালে। প্রথমবারে এমনটি ঘটেছিল বামপন্থী শাসনের প্রথম পর্যায়ে। কিন্তু সিনিয়র আসাদ দেশকে ঐ অবস্থান থেকে পরে ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাশার আসাদ ভুল শুধরালেন না। দেশকে তিনি টেনে নিয়ে গিয়ে হাজির করালেন তার বাবার আগের জমানায়। ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যখানে এনে খাড়া করেছেন বাশার তার দেশকে। দেশের জনগণের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধে নেমেছেন এবং বিজয় খুঁজছেন।

পর্যবেক্ষকরা তার পতন আসন্ন দেখতে পাচ্ছেন। তারা বলছেন, জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী অবস্থান নিয়ে দেড় বছর পার করে দেয়ার পরও নিজের প্রশাসনের জন্য কোনো স্বস্তি-শান্তির ঠিকানা বাশার এ পর্যন্ত খুঁজে পাননি। রাজনৈতিক মুক্তির কোনো পথ বাশারের সামনে খোলা দেখা যাচ্ছে না। জনগণের বিরুদ্ধে তার সামরিক কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হচ্ছে এখন তার সামনে একমাত্র বিকল্প। জনগণের মধ্যে আতংক জিইয়ে রেখে নিজেকে তিনি রক্ষা করতে চান। কিন্তু আতংকের দেয়াল ভাঙতে শুরু করেছে- যার প্রমাণ জনগণ দিচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে নেমে। যে বণিক সম্প্রদায় এতোদিন বাশারকে সমর্থন দিয়ে এসেছিলেন, তারাও এখন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাশারের কর্মগুণে উধাও হতে দেখতে পাচ্ছেন। বাশারের পাশে দাঁড়াতে এখন তারা আর প্রস্তুত নন।

বাশারের বর্তমান সাম্প্রদায়িক অবস্থানকে গণনায় নিয়ে ভাষ্যকাররা এখন বলছেন, একান্তভাবে শিয়া ইরানের সাহায্য-সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল বাশার নিজের দেশের নিরাপত্তা বজায় রাখার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বিকল্প কোনো পথ উন্মুক্ত থাকতে দেননি। ইরানের আজ্ঞাবহ ভূমিক পালন ছাড়া বাশারের সিরিয়ার সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই মনে করেন ভাষ্যকাররা। আদতে ঐ পথেই কি বাশার সিরিয়াকে এগিয়ে নিতে যাচ্ছেন। বাশার কি ধরে নিয়েছেন যে, ইরান তার পক্ষে যুদ্ধে নামবে? যদি তেমনটি ঘটে তাহলে ইরানের জন্য তা হবে বিপর্যয়কর। অনেকেই বলছেন সম্ভবত ইরান ঐ পথে এগোবে না।

অন্যদিকে, একমাত্র ইরানের ওপর নির্ভরশীল সিরিয়া শুধু আরব অঞ্চলের নয়, বাইরের দুনিয়ার বহু দেশেরও চক্ষুশূলে পরিণত হবে। সৌদি আরব, উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশ, তুরস্ক, মিশর, জর্দান, আমেরিকা ও ইউরোপ-এতোগুলো প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার বিষয়টি সিরিয়া বা ইরানের কল্পনাতেও স্থান পেতে পারে না। ইরানের বর্তমান কূটনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও অবস্থানের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিচ্ছেন, নিজের পারমাণবিক কর্মসূচীর ভবিষ্যতকে অগ্রাধিকার রেখে এবং নিজের আর্থিক সামরিক তথা রণকৌশলগত সামর্থ্য বিবেচনায় রেখে বিশ্বসম্প্রদায় ও বিশেষভাবে ইউরোপের ইরান বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইবে না। আসাদ প্রশাসন ও তার নিজের পারমাণবিক কর্মসূচীর সুরক্ষা দুটোর মধ্যে পরবর্তীটিকেই স্বাভাবিকভাবে বেশি গুরুত্ব দেবে ইরান।

সিরীয় সংকটে রাশিয়ার ভূমিকা আরো জটিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার স্বার্থ সম্পর্ককে ধূলায় মিশিয়ে শুধুমাত্র বাশার আসাদের সুরক্ষার জন্য যুদ্ধে নেমে পড়বে না রাশিয়া। যে কয়টি বিশ্ববৈরী দেশ ও গোষ্ঠীর সঙ্গে সখ্য গড়ার জন্য এমন করুণ অবস্থায় নিক্ষিপ্ত আজ বাশার আসাদ তাদের বর্জন করে প্রতিবেশী আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর তথা ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক শুধরে নেয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে আসা এতোদিন পরে বাশার আসাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি? এমন সম্ভাবনার কথাও কোনো কোনো ভাষ্যকারকে উচ্চারণ করতে শোনা গেছে-তাই এই প্রশ্ন। যে ত্বরিত গতিতে সিরিয়ার ঘটনাবলী ঘটতে শুরু করেছে মনে হয়, প্রশ্নের উত্তরও তেমনি দ্রুতির সঙ্গে সামনে এগোচ্ছে।

অনলাইন ডেস্ক