অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে বহু আগ থেকে। তবে তা এত ব্যাপক এবং খোদ ইফা’র ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হবে তা যুগপৎভাবে অবিশ্বাস্য অসহনীয় এবং খবরদাশতযুক্ত ছাত্রলীগে শিবির কর্মীরা ঢুকে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে কূটকৌশলে মারামারি লাগিয়ে দিচ্ছে- এ অভিযোগ শুধু বহুবারই উত্থাপিত হয়নি, নিশ্চিত প্রমাণিতও হয়েছে।
জামাতীরা যে এখন মুক্তিযোদ্ধাও বনে গেছে তাও এখন ওপেন সিক্রেট। এসব অভিযোগ আরো বিস্তৃতি হয়ে খোদ আওয়ামী লীগেই জামাত ঢুকে গেছে তাও এখন দলের শীর্ষ নেতারাই অকুন্ঠচিত্তে স্বীকার করছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলছেন যে, প্রশাসনে জামাত-জোট গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। এই যখন অবস্থা তখন এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেক নজর লাভে সমর্থ হয়ে যারা বিভিন্ন দায়িত্ব তথা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তারা এ ব্যাপারে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করবেন, নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন এটাই ছিলো কাঙ্খিত ও বাঞ্ছিত। কিন্তু তা যারা করছেন না তারা যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তার সরকার তথা গোটা দেশবাসীর গভীর শত্রু জামাতীদেরই হাত শক্তিশালী করছেন, নিখাদ মুনাফিকী করছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিয়োগ বাণিজ্য সম্পর্কিত খবরে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের এ বড় প্রকল্পে জামাতের কর্মীদের পুনরায় নিয়োগ দেয়াকে কেন্দ্র করে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। উল্লেখ্য, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্প শুরু হয় ১৯৯২ সাল থেকে।
এরপর থেকে এ প্রকল্পে মূলত জামাতপন্থী লোকদের নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। তাদের অধিকাংশ মাদ্রাসায় শিক্ষা নিয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে ২০০৮-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত এ কর্মসূচি চালু ছিল। বর্তমান সরকার পঞ্চম পর্যায়ে এ প্রকল্প চালু ও সম্প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রকল্প চলবে চার বছর। এতে ব্যয় হবে ৬৪৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। জোট আমলে বরাদ্দ ছিল ২২২ কোটি টাকা। শিশুদের জন্য মসজিদভিত্তিক প্রাক্-প্রাথমিক শিশু শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধি করা প্রকল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, জোট সরকারের সময় ৩০ হাজার প্রাক্-প্রাথমিক, কোরআন শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মোট শিক্ষাকেন্দ্র বাড়িয়ে ৩৬ হাজার
৭৬৮টিতে উন্নীত করা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত চার পর্যায়ে ৫৩ লাখ ৫৮ হাজার জনকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। ওই কর্মসূচি সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে ১ কোটি ৩৭ লাখ শিশু-কিশোর-বয়স্ককে শুদ্ধভাবে কোরআন শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষারপাশাপাশি সাক্ষরজ্ঞানসহ প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হবে। এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জোট আমলে ৩১ হাজার ৭৬৮ জন শিক্ষক, ১ হাজার ৪৭৪ জন কেয়ারটেকার, ৫৮৬ জন ফিল্ড অফিসার, ফিল্ড সুপারভাইজার, মাস্টার ট্রেইনার নিয়োজিত ছিল। স্থানীয় প্রশাসন থেকে লিখিতভাবে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে জানানো হয়, শিক্ষকদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই জামাতের সঙ্গে জড়িত। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবাই জামাতের লোক। সব মিলিয়ে জামাতের সতেরো হাজারের বেশি দলীয় লোক এই প্রকল্পে প্রতিপালিত হয়েছে। এমনকি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি অবহিত করা হয়। গত বছর একনেকে এ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। তখন বৈঠকে এ প্রকল্পে যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দিতে বলা হয়। যাতে করে ধর্মান্ধ ও জামাত মনোভাবাপনরা নিয়োগ না পায়। ধর্মীয় শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়।
কিন্তু নিজামীর জামাতের অনুচর ও মিত্র সম্পৃক্ত বর্তমান কথিত যাচাই বাছাই কমিটি তা না করে জামাতের লোকদেরই বহাল রেখেছে। জামাত অনুচর এ যাচাই-বাছাই কমিটি সাধারণ কেয়ারটেকার, ফিল্ড অফিসার, ফিল্ড সুপারভাইজার, মাস্টার ট্রেইনার পদে ৫৮৮ জনকে বাছাই করে নিয়োগ দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। তাদের সবাই জামাতের লোক। জামাতের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিতেও রয়েছেন অনেকে। ফিল্ড অফিসার, ফিল্ড সুপারভাইজারদের ফাউন্ডেশন থেকে মোটরসাইকেল দেয়া হয়। এসব মোটরসাইকেল জামাতের দলীয় সাংগঠনিক কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। জোট সরকারের সময় তারা নির্ভিগ্নে দলীয় তৎপরতা চালিয়েছে। সরকারি অর্থে জামাতের কর্মীদের লালন ও তারা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ যাতে না পায়, সে জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটি আর চালু না করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত ধর্মশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে সরকার কর্মসূচি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এগারো থেকে বিশতম গ্রেডের পদে নিয়োগে নির্বাচনী কমিটিতে বিশেষজ্ঞ বা অন্য কোনো নামে বাইরের লোক রাখার বিধান ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এতে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বাইরের তিনজনকে রাখা হয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে। নন-গেজেটেড ফিল্ড সুপারভাইজার পদে ৪৬০ জন, ফিল্ড অফিসার ৬৪ জন ও মাস্টার ট্রেইনার পদে ৬৪ জনকে বাছাই করা হয়েছে। এরা প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ের কর্মসূচিতে নিয়োজিত ছিলেন। বাছাই কমিটি তাদের সবাইকেই বাছাই করে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এখন তাদের নিয়োগ দেবেন। মসজিদের ইমাম হিসেবে কর্মরতদের শিক্ষক পদে প্রায় সবাইকে বহাল রাখা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালকের নেতৃত্বাধীন কমিটি অন্যান্য পদে লোক বাছাই করার ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফিল্ড সুপারভাইজার, মাস্টার ট্রেইনার ইত্যাদি পদে জনপ্রতি দুই লাখ টাকা করে নেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যাচাই-বাছাই কমিটির অন্যতম মূলনিয়ন্ত্রক মাওলানা মিছবাহুর রহমান চৌধুরী একজন চিহ্নিত নিজামী বান্ধব লোক। নিজামীর সাথে তার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের অনেক ছবিও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এসেছে। তার ধুরন্ধর ও ধর্মব্যবসায়িক চরিত্রটি সর্বজনবিদিত। তবে তার নিজামী প্রীতি যে কমার পরিবর্তে উল্টো বেড়েছে তা নতুন করে এবং আরো বেশি করে মসজিদভিত্তিক শিশু কার্যক্রমে জামাতীদের নিয়োগ পদ্ধত্বির দ্বারা প্রতীয়মান হয়। উল্লেখ্য, নিজামী ও জামাতের বিরুদ্ধে দু-চারটা আপাত বিরোধী বক্তব্য দিয়েই তিনি আওয়ামী মিত্র সেজেছিলেন। কিন্তু এ যে নিজামী-জামাতের এক সুচতুর খেলা তা আওয়ামী লীগ এখনও আমলে নিবে কী? বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজর কাড়বে কী? তা না হলে প্রায় হাজার কোটি টাকাই কেবল নয় বরং লাখ-লাখ কোমলমতি শিশুকে জামাতীরা তাদের মওদুদী আদর্শে উজ্জীবিত করে জঙ্গি-জামাতী বীজ ঢুকিয়ে দিবে। নাউযুবিল্লাহ! তারপরও কী তা প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে থেকে যাবে? এ প্রশ্নটি আরো তীব্রভাবে নিবদ্ধ হচ্ছে এ কারণে যে, সম্প্রতি সারাদেশে কাজী নিয়োগেও একই অবস্থা হয়েছে। বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের মত একটা স্পর্শকাতর ও বিদগ্ধ মন্ত্রণালয়ে থাকার পরও সেখানে স্থান দখল করে নিয়েছে জামাতী নজরানা নেওয়াজ। উল্লেখ্য, জামাতী মওদুদীরা স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করতে গিয়ে পাকিদের নারী-মদ, টাকা-পয়সা ইত্যাদি তথাকথিত নজরানা নেওয়াজ দিয়ে হাত পাকিয়েছে।
কিন্তু কথা হলো, সে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরের স্বাধীনতা পক্ষের লেবাছধারী হাত মেলায় কী করে? তাদের প্রলুব্ধ হয় কী করে? সেক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও নীতি-নির্ধারকদের নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে যে, প্রশাসনে শুধু জামাত-জোটের লোকেরাই নয় বরং খোদ আওয়ামী বেশধারী যেসব সুযোগসন্ধানী দুর্নীতিবাজ তথা জামাত-জোটের নজরানা-নেওয়াজ দ্বারা প্ররোচিত ও প্রভাবিত স্বার্থবাদী রয়েছে তাদেরকেও অচিরেই অবিলম্বে অনিবার্যভাবে বদলিয়ে দিতে হবে। তবেই দিন বদলের সরকারের স্বপ্ন পূড়ন হবে। নচেৎ এরাই দিন বদলের দাবিকে বদলিয়ে দিবে। কারণ এরা ঘাপটি মেরে থাকা ভয়ঙ্কর মুনাফিক ও প্রচন্ড- দুর্নীতিবাজ। স্বার্থের জন্য এরা খোদ সরকারের গোড়া কাটতে বিলক্ষণ দ্বিধা করবে না। একথাটি সরকার যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততই তার ও দেশের জন্য মঙ্গল।