আত্মশুদ্ধির মাস মাহে রমজান। মহান আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়ার চেষ্টা করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় সেই মাহে রমজান। গুনাহ থেকে পুত-পবিত্র হওয়ার মাস মাহে রমজান। প্রতিটি মুসলমানের জীবনে তাই মাহে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
সেই মাহে রমজানে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব রকম পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয় রোজাদারদেরকে। প্রাকৃতিকভাবে সূর্যের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ও দেশে রোজা রাখার সময় কম বেশি হয়। দেশের ভৌগলিক অবস্থানের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয় এই সময়। এ কারণেই সময়ের মধ্যে তারতম্য হয়ে থাকে। কোথাও রোজা রাখতে হয় ২২ ঘন্টা আবার কোথাও ১০ ঘন্টারও কম। গত ২০১৯ সালে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রোজা পালন করেন সুমেরীয় অঞ্চলের মুসলিমদের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে। এ বছর এখানকার মুসলমানরা ২০ ঘন্টার বেশি সময় পানাহার থেকে বিরত থাকেন। অথচ শীতকালে এ অঞ্চলের মুসলমানদেরকে সিয়াম সাধনা করতে হয় মাত্র আট ঘন্টার মতো। ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সিয়াম সাধনা করতে হয় স্কটিসহাইল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দাদের। এখানে সূর্য লম্বা সময় ধরে থাকে। ২০১৯ সালে সবচেয়ে কম সময় রোজা রাখেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির মানুষ। এ বছর চিলির আকাশে সূর্য থাকে ৯ ঘন্টা ৪৩ মিনিট। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও রোজার সময় কম। এখানে রোজা রাখার সময় ১১ ঘন্টা ২৪ মিনিট। অন্যদিকে, সারা মাস সবচেয়ে বেশি সময় রোজা রাখতে হয় ব্রিটেনবাসী ও আইসল্যান্ডবাসীকে। আইসল্যান্ডে দিনের আলো থাকে ২২ ঘন্টা। তাই এখানকার মুসলমানরা সর্বোচ্চ কষ্ট সাধ্যের মধ্যে রোজা পালন করে থাকেন। আর ব্রিটেনের রোজার সময় প্রায় ১৯ ঘন্টা। ব্রিটেনে রোজা রাখার এই সময় মধ্যপ্রাচ্য বা বিশ্বের যেকোনো মুসলিম দেশে রোজা রাখার সময়ের তুলনায় বেশি। যেসব দেশে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত ঠিকমতো হয়না যেমন আলাস্কায় ও আর্কটিক অঞ্চলে-গ্রীষ্মকালে সেখানে ৬০ দিন পর্যন্ত সূর্যাস্ত হয়না। সেসব দেশ পাশের দেশের সঙ্গে মোটামুটি মিলে এই সময়ে রোজা রাখতে হয় এবং রোজা ভঙ্গ করতে হয়। তবে নরওয়ের উত্তরাঞ্চলের ইসলামী চিন্তাবিদরা ফতোয়া দিয়েছেন, মক্কার সঙ্গে মিলিয়ে এখানকার মুসলমানরা রোজার সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারবেন। নরওয়েতে রোজার সময়সীমা ২০ ঘন্টার বেশি। মার্কিন ইসলামী চিন্তাবিদরাও বলেছেন, আলাস্কার উত্তরাঞ্চলের মুসলমানরা পাশের রাজ্যের সময়সীমা অনুযায়ী রোজা রাখতে এবং ভাঙ্গতে পারবেন। খুব গরমে রোজা রাখতে হয় সুইডেনে। দেশের ৫ লাখ মুসলমানের মধ্যে যারা রোজা রাখেন তারা ইফতার করার মাত্র চার ঘন্টার পরই সাহরী খেতে হয়। সুইডেনের মুসলমানরা ২০১৯ সালে প্রায় ২১ ঘন্টা রোজা রাখেন। যুক্তরাষ্ট্রের আলস্কায় রোজা রাখতে হয় ২০ ঘন্টা। জার্মানিতে রোজা রাখতে হয় ১৯ ঘন্টা। আমাদের বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে রোজা রাখতে হয় প্রায় ১৫ ঘন্টা এবং শীতকালে রোজা রাখতে হয় ১২ ঘন্টা।
মাহে রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন দেশে থাকে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও নানা ধরনের আয়োজন। এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলোঃ
সৌদি আরবঃ সেখানে রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন কোম্পানির জিনিসে থাকে বিশেষ ছাড়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য থাকে হাতের নাগালে। আর ক্রয়-অক্ষম মানুষদের জন্য বাদশার পক্ষ থেকে দেয়া হয় গিফট বক্স। যাতে থাকে তেল-চিনি-দুধসহ অন্যান্য দ্রব্য। মহিমান্বিত রমজান মাস পালনে সৌদিতে মাস দুয়েক আগ থেকে চলে প্রস্তুতি। একে অপরের দেখা হলেই ‘শাহরু আলাইকা মোবারাকা’ বলে কুশল বিনিময় করেন। রমজান শুরু হওয়ার সপ্তাহ-দশদিন আগে থেকেই এখানে রাস্তার পাশে কিংবা বাজার-মার্কেটে শোভা পায় সারি সারি তাবু। অনেকগুলো আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। রোজাদারদের ইফতার করানোর জন্যই তৈরি করা হয় এসব। তাবুগুলোতে ব্যবস্থা করা হয় ভালো ইফতারের। খেজুর, বোতলজাত পানি, জুস, মাঠা, ফল, কফি, চিকেন-বিরিয়ানি, এলাকা ভিত্তিক ঘরোয়া খাবার ইত্যাদি। পুরো রমজান মাসে ভিনদেশি শ্রমিকদের ইফতার বা সাহরি কিনতে হয়না। এসব কাজ পুরোপুরি নিজস্ব উদ্যোগেই হয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রঃ এখানে প্রায় ৭০ লাখ মুসলমান। বেশির ভাগ মুসলমান বাস করেন ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ইলিনয়েস, ইস্তিয়ানো, মিশিগান, টেক্সাস, ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যগুলোতে। এশিয়ান মুসলমানরা এখানে যারা বসবাস করেন তারা তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে পায়জামা, পাঞ্জাবি, কাবুলি সেট কোর্তা পরিধান করেন এবং মহিলা ও শিশুরা মেহেদি দিয়ে হাত রাঙান। অন্যদিকে আফ্রিকান মুসলিম যারা এখানে বসবাস করেন তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করেন। আমেরিকায় ইফতার সামগ্রীর মধ্যে খেজুর, খোরমা, সালাদ, পনির, রুটি, ডিম, গোশত, ইয়াগার্ট, হট বিনস, স্যুপ, চা ইত্যাদি থাকে। রমজান মাসে হোয়াইট হাউসে ইফতার পার্টি প্রথম শুরু করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। এটা বর্তমানে একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কানাডাঃ রাজধানী অটোয়ায় সর্বাধিক মুসলমান বসবাস করেন, সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। অটোয়া ছাড়াও সাসকেচুয়ান অল্টারিও, সিনেটোবা, টরেন্টো, কুইবেক রাজ্যগুলোতে মুসলমানরা বসবাস করেন। রমজানে ইফতার পার্টির আয়োজন চলে মহাসমারোহে এবং প্রতি শনিবার অটোয়া ইসলামিক সেন্টারের ইফতার পার্টিতে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মুসলমান হাজির হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘দ্য মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ ইফতার পার্টির আয়োজন করে। ইফতারিতে খেজুর, খোরমা, পনির, সালাদ, ফল, স্যুপ, জুস, রুটি, ডিম, গোশত, চা-কফি ইত্যাদি থাকে।
ইতালিঃ দেশটির অধিকাংশ অধিবাসী ক্যাথলিক খ্রিস্টান, তা ছাড়া বৌদ্ধ ও ইহুদী আছে। সমগ্র জনসংখ্যার ১% হলো মুসলমান। এই অল্প সংখ্যক মুসলমান রমজানকে ঘটা করে স্বাগত জানায়। ইফতারিতে তারা বার্গার জাতীয় খাদ্য, নানাবিধ ফল যেমন-মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর, বিভিন্ন ফলের রস খান। সাহরিতে তারা বার্গার ও বার্গার জাতীয় খাদ্য বেশি পছন্দ করে।
জার্মানিঃ এখানে প্রায় ৩০ লাখ মুসলমান, যাদের বেশির ভাগ শ্রমিক এবং তারা বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে এসেছে। বর্তমানে এদেশে দুই হাজার মসজিদ আছে। শীত মৌসুমে এখানে সূর্য উঠে সকাল ৮টায় এবং সূর্য ডুবে বিকেল ৪টায়। তাই কাজের মধ্যেই ইফতারের সময় হয়ে যায়। বড় বড় প্রতিষ্ঠানসমূহে মুসলমান শ্রমিকদের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়।
সুদানঃ আফ্রিকা মহাদেশের বড় একটি মুসলিম দেশ হল সুদান, যার রাজধানীর নাম খার্তুম। এখানে ইফতারি সাধারণত খেজুর দিয়ে করা হয়। তা ছাড়া ‘হামড়া’, লাহমা’ নামক গোশত দিয়ে তৈরি খাদ্য তারা খেয়ে থাকে। চালের তৈরি ‘আছিদা’ এক ধরনের পিঠা তারা খায়। গোশত ও সস দিয়ে তৈরি ‘মুলাহ’ নামক খাদ্য ও তারা ইফতারিতে খায় এবং একই সঙ্গে ‘গাওয়া’ নামক চা জাতীয় পানীয় তারা পান করে। সুদানিরা ‘শোরবা’ নামক স্যুপ, মাংস দিয়ে তৈরি ‘মুহাম্মার’ নামক খাবার, দুধ ভাত দিয়ে তৈরি ‘রুসবিল হালিব’ সালাদ দিয়ে খায়। তদুপরি তারা পায়েশ, ক্ষির, ফিরনি-এগুলো তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে থাকে।
মিসরঃ রমজানে এখানে অফিসের কর্মঘন্টা কমানো হয় যাতে সিয়াম পালনকারীরা মসজিদে ইবাদতে পর্যাপ্ত সময় পান। দিনের কাজকর্ম করে তারা রাতে কিয়ামুল লাইল, তারাবিহ এবং কোরআন তেলাওয়াত করে কাটিয়ে দেন। জোহরের সালাতের পর থেকে ‘বাজারের শহর’ নামে খ্যাত রাজধানী কায়রো শহরের অলিগলিতে ঢাকার চক বাজারের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে হরেক রকম ইফতারের আয়োজন। ইফতারে ঐতিহ্যবাহী পানীয় ‘শরবত কামার আল-দ্বীন’ সব বয়সীরা পান করে থাকে। মরুভূমির এই দেশে ইফতারিতে খেয়ে থাকে ‘কানাফা’ নামক পিঠা যা আটা, মধু, বাদাম, কিসমিস ও চিনি দিয়ে তৈরি করা হয়। আরেক ধরনের গোলাকার ছোট পিঠা ‘তায়েফ’ তাতে বাদাম ও কিসমিস বেশি থাকে তাও তারা খেয়ে থাকেন। মিসরীয় শিশুদের কাছে রমজান মাসটি সবচেয়ে বেশি আনন্দময়। তারা এ সময় আমাদের দেশের বাচ্চাদের মতো পিতা-মাতার কাছে রোজা রাখার দাবি জানায়। মিসরের মুসলমানরা ইফতার করেন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাসায়।
এ. কে. আজাদ - বার্তা সম্পাদক