মুসলিম জাতির দু'টি আনন্দ-উৎসবের প্রধান উৎসব হলো ঈদুল ফিতর। এ দিনে মুসলিমগণ সুন্দর পোষাকে সুসজ্জিত হয়ে ঈদগাহে যান। ঈদের সালাত আদায় করেন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশি, গরীব-মিসকীন নির্বিশেষে সকলের সাথে আনন্দ-উলস্নাস করেন।
এখানেই কথা; আমরা মুসলিম হয়ে এ দিনে কোন্ ধরনের আনন্দ-উলস্নাস করে থাকি?!
এ দিনে অনেক মুসলিম ভাই-বোনেরা এমনও সব অনৈসলামিক কার্যকলাপ ও বিজাতীয় সংস্কৃতি-উৎসব পালনে মেতে ওঠেন; যা ইসলাম কখনই অনুমোদন করে না। আলস্নাহর রাসূল সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গেলেন। তিনি মদীনাবাসীকে পারসিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বসনত্দের পূর্ণিমা রজনীতে 'মেহেরজান' আর হেমনত্দের পূর্ণিমা রজনীতে 'নাওরোজ' নামক উৎসবে এমন সব আমোদ-প্রমোদে মেতে ওঠতে দেখলেন; যা সুস্থ বিবেকের কাছে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি মদীনাবাসীকে ডেকে বললেন: এ বিশেষ দিনে তোমাদের আনন্দ-উলস্নাসের কারণ কি? মদীনার নওমুসলিমগণ বললেন: আমরা জাহিলী যুগ হতে এ দু'টি দিন এভাবেই পালন করে আসছি।
মহানবী সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম বললেন: وَقَدْ أَبْدَلَكُمُ اللَّهُ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا يَوْمَ الْفِطْرِ وَيَوْمَ الأَضْحَى "আলস্নাহ এ দু'টি দিনের পরিবর্তে অন্য দু'টি দিন তোমাদের উৎসব করার জন্য নিধর্ারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হল 'ঈদুল ফিতর', অন্যটি 'ঈদুল আযহা'। তোমরা পবিত্রতার সাথে এ দু'টি উৎসব পালন করবে।" [আবু দাউদ ও নাসায়ী]।
২য় হিজরীর রমাযান মাস প্রায় শেষ হতে চলেছে। আর মাত্র দু'দিন বাকি। অহী নাযিল হল:
قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّى14 وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى15"নিশ্চয় সে ব্যক্তি সাফল্য অর্জন করেছে, যে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করেছে এবং তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করেছে। অত:পর সালাত আদায় করেছে।" [সূরা আ'লা: ১৪-১৫]। আহকামুল কুরআনে বলা হয়েছে: "এখানে সালাত আদায় করা দ্বারা ঈদুল ফিতরের সালাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে।" [আহকামুল কুরআন: ৩য় খন্ড, পৃ ৪৭৫]।
এর পরে নাযিল হয়: إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ1 فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ 2 "আপনি আপনার প্রভুর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করম্নন এবং কুরবানী করম্নন।" [সূরা কাওছার: ২]। হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন: এ আয়াতটিতে ঈদুল আযহার সালাত ও কুরবানীর নির্দেশ দান করা হয়েছে। [আহকামুল কুরআন, প্রাগুক্ত]।
দ্বিতীয় হিজরী হতে মুসলিম উম্মাহ যথারীতি প্রতি বছর ঈদুল ফিতর পালন করে আসছে। এ হিসেবে মুসলিম মিলস্নাতের এবারের ঈদুল ফিতর হলো ১৪৩২তম।
ঈদুল ফিতরের পরিচয়:
ঈদ্ عِيْدٌ অর্থ: উৎসব, পর্ব, আনন্দ। আর ফিতর فِطْر অর্থ: ফাটল, চির, ভাঙ্গন, ভাঙ্গা। এদিক হতে ঈদুল ফিতর عِيْدُ الْفِطر অর্থ হলো: রোযা ভাঙ্গার পর্ব বা উৎসব। দীর্ঘ এক মাস রোযা রাখার পর আলস্নাহর নির্দেশে আমরা এদিনে রোযা ভাঙ্গি বলে এ দিনটির নাম ঈদুল ফিতর।
মূলত: ঈদ শব্দটি আরবী عَوْدٌ মূলধাতু হতে এসেছে। এর অর্থ: ফিরে আসা, বারবার আসা। আর ফিতর মানে ভঙ্গ করা। যেহেতু ঈদুল ফিতর প্রতি বছরই যথা নিয়মে আমাদের মাঝে বারবার ফিরে আসে এবং যেহেতু এ দিনটিতে আমরা একটি মাসের শৃঙ্খলা তথা সুবহি সাদিক থেকে সূর্যাসত্দ পর্যনত্দ পানাহার ও ইন্দ্রিয় সম্ভোগে লিপ্ত না হওয়ার যে বিধান ছিলো তা ভঙ্গ করি বলে এদিনটিকে ঈদুল ফিতর বলা হয়েছে।
রাসূল সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম এদিন সম্পর্কে বলেছেন: أَنْ لاَّ تَصُوْمُ هَذِهِ الأَيَّامَ فَإِنَّهَا أَيَّامُ أَكْلٍ وَّشَرْبٍ وَّبِعَالٍ এদিনটিতে তোমরা রোযা রেখো না। এদিন তোমাদের জন্য আনন্দ-উৎসবের দিন। খাওয়া, পান করা আর পরিবার-পরিজনদের সাথে আনন্দ-উৎসব করার দিন। [মুসনাদ আহমাদ, ইবনু হিব্বান]
ঈদুল ফিতরে করণীয়: একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে এ দিনের ধর্মীয় ও সামাজিক অনেক করণীয় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো:
ধর্মীয় করণীয়: ঈদুল ফিতরের ধর্মীয় করণীয়গুলো হলো:
০১. রোযা না রাখা: ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম। তাই ঈদুল ফিতরের দিনে রোযা রাখা আমাদের জন্য মোটেও ঠিক হবে না। আবু সাঈদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: "রাসূল সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম দু'ঈদেও দিন (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহায়) রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন।" [সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম]
০২. গোসল করা: ঈদের সালাতের পূর্বে গোসল করা সুন্নাত। আব্দুলস্নাহ ইবনে উমার (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসুল সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম ঈদের নামাযে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক]। অনুরূপ সাঈদ ইবনে যুবাইর (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, ঈদুল ফিতরের তিনটি সুন্নাত রয়েছে: পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, গোসল করা ও ঈদগাহে যাবার পূর্বে কিছু খাওয়া।
০৩. হালকা কিছু খাওয়া: ঈদের নামাযে যাওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া সুন্নাত। হাদিসে খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়ার কথা উলেস্নখ করা হয়েছে। আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম খেজুর না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না। [সহীহ আল বুখারী]।
০৪. সুগন্ধি ব্যবহার করা: ঈদের দিন আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত। ইমাম মালিক (রহ.) বলেন: মুসলিম প-িতগণ প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার করা ও সুসজ্জিত হওয়াকে মুসত্দাহাব বলেছেন। [আল মুগনী]।
০৫. সুন্দর পোষাক পরিধান করা: ঈদের আরেকটি করণীয় হলো এদিনটিতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর পোষাক পরিধান করা। জাবির (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসুল সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম এর একটি সুন্দর জুব্বা ছিল যা তিনি দুই ঈদে ও জুম'আর দিনে পরিধান করতেন। [মুসনাদ বায়হাকী]।
০৬. সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা: ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূল সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া সালস্নাম বলেছেন: আলস্নাহ সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করাকে বাধ্যতামূলক করেছেন। যা একদিকে অশস্নীল-অনর্থক কথা ও কাজ দ্বারা কলুষিত রোযাকে পবিত্র করে, অন্যদিকে অসহায়-নিঃস্বকে খাদ্যদানে সহায়তা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যে ব্যক্তি সাদাকাতুল ফিতর ঈদের নামাযের পূর্বে আদায় করে, তা কবুল করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পরে আদায় করবে, তা সাধারণ সাদাকাহ হিসেবে পরিগণিত হবে। [সহীহ ইবনু খুযাইমা]।
০৭. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া: সাঈদ ইবনু যুবাইর (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। তবে হেটে যাওয়া সম্ভব না হলে বাহনে চড়ে ঈদগাহে যাওয়া দোষণীয় নয়।
০৮. এক রাসত্দা দিয়ে যাওয়া অন্য রাসত্দা দিয়ে আসা: ঈদের আরেকটি সুন্নাত হলো: এক রাসত্দা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং অন্য রাসত্দা দিয়ে ফিরে আসা। এতে দীর্ঘ হাটা এবং বেশি মানুষের সাথে মিশার উপকারিতা রয়েছে। ইবনু যুবাইর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম এক রাসত্দা দিয়ে ঈদের সালাতে যেতেন এবং অন্য রাসত্দা দিয়ে ফিরে আসতেন। (সহীহ আল বুখারী)
০৯. তাকবীর বলা: তাকবীর বলতে বলতে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। রমাযান সংক্রানত্দ আয়াতের শেষের দিকে আলস্নাহ তা'আলা বলেছেন: তোমরা (রমাযানের) রোযা পূর্ণ করো এবং আলস্নাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্টত্ব বর্ণনা করো। [সূরা আল বাকারা: ১৮৫]।
ইবনু উমার (রা.) হতে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত আছে যে, রাসুল সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছার পূর্ব মূহুর্ত পর্যনত্দ তাকবীর বলতেন। ইমাম মুহাম্মাদ শিহাব আয যুহরী সর্বদা বলতেন: "সবার উচিত ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যনত্দ তাকবীর বলা।"
তাকবীর বলতে হবে এভাবে: اَللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، اَللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ، وللَّهِ الْحَمْدُ এর সাথে বাড়িয়ে এভাবেও বলা যাবে: اَللهُ أَكْبَرُ كَبِيْرًا، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيْرًا، سُبْحَانَ اللهِ بُكْرَةً وَّأَصِيْلاً [আত তাবারানী]।
১০. ঈদ শুভেচছা বিনিময়: ঈদের দিনে পারস্পারিক ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করা ঈদের আরেকটি সুন্নাত। প্রত্যেক জাতি তাদের স্ব স্ব ভাষায় শুভেচছা বিনিময় করতে পারে। " তাক্বাব্বালুলস্নাহা মিন্না ওয়া মিনকুম" (আলস্নাহ আমাকে ও আপনাকে কবুল করম্নন)। এ জাতীয় যে কোন বাক্য দ্বারা ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করা।
১১. ঈদের সালাত আদায় করা: ঈদের দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কোন সালাত আদায় করা ঠিক নয়। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: রাসূল সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম ঈদের দিন বের হয়ে শুধুমাত্র ঈদের দু' রাকা'আত সালাত আদায় করতেন। ঈদের সালাতের পূর্বে বা পরে নফল বা অতিরিক্ত কোন সালাত আদায় করতেন না। [সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম ও সুনান আত তিরমিযী]। ইবনু উমার, আবু সাঈদ ও ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্নিত আছে, মহানবী সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম খুতবাহর আগে ঈদের সালাত আদায় করতেন। [সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম]।
১২. খুতবাহ শুনা ও দু'আ করা: ঈদের সালাতের পরে ইমাম সাহেব খুতবাহ প্রদান করবেন এবং মুসলিস্নগণ তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করবেন। এটি পালন করা ওয়াজিব। খুতবাহতে মুসলিম উম্মাহর দিক-নির্দেশনামূলক বাণী ও সকলের কল্যাণের জন্য দু'আ থাকা বাঞ্ছনীয়। রাসূল সালস্নালস্নাহ আলাইহি ওয়া সালস্নাম বলেন: "আলস্নাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত বস্তু হল দু'আ।" আলস্নাহ স্বয়ং মানুষকে দু'আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যারা দু'আ করে না তাদেরকে তিনি অহংকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আলস্নাহ ইরশাদ করেন: "আমার কাছে প্রার্থনা কর, আমি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করবো। যারা অহংকারাবশে আমার ইবাদত হতে বিমূখ, তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে।" [সূরা মু'মিম: ৬০]।
তাই এদিনে আমাদের উচিত মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, মুসলিম উম্মাহর সার্বিক কল্যাণ ও মৃতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে আলস্নাহর কাছে দু'আ করা।
সামাজিক করণীয়:
এদিনের সমাজিক করণীয় বলতে পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন, গরীব-অসহায় নির্বিশেষে সকলের সাথে মিশা, সকলের খোজ-খবর নেয়া, সাধ্যমত তাদেরকে বাসা বা বাড়ীতে নিমন্ত্রণ জানানো। এছাড়া ঈদগাহের কাজে শরীক হওয়া, দলে দলে তাকবীর বলতে বলতে ঈদগাহে যাওয়া, সবার সাথে আনন্দ-খুশি প্রকাশ করা, পারস্পারিক ভাব বিনিময় ও সকল ভেদা-ভেদ ভুলে সবার সাথে একাকার হয়ে যাওয়াকে বুঝে থাকি।
পরিশেষে বলতে চাই ঈদুল ফিতরের ধর্মীয় করণীয়গুলো পালন করার মাধ্যমে নিজেকে ধর্মীয় অনুভূতি সম্পন্ন একজন প্রকৃত মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলা এবং সমাজিক করণীয়গুলো পালনের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শানত্দি, শৃঙ্খলা, ভ্রতৃত্ব, সাম্য, সম্প্রীতি, সংহতি ও সহমর্মিতার নজির স্থাপন করা আমাদের একান্ত করণীয়।
লেখক: মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম
এম.ফিল. গবেষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া