একজন সৎ, তাক্ওয়াবান ও সুপথগামী মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ ও মহান বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে ফিরে আসে মাহে রমাযান। কুরআনে বলা হয়েছে: রমাযান মাস, যে মাসে মানুষের হিদায়াতের জন্যে, হিদায়াতের সুস্পষ্ট প্রমাণাদি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে নাযিল করা হয়েছে আল কুরআন। [সূরা আল বাকারা: ১৮৫]।

কুরআন ও হাদীছে এ মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফযিলাত বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। তবে আলোচ্য প্রবন্ধে ইসলামের দৃষ্টিতে এ মাসের দাবী ও করণীয়গুলো সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।

রমাযানের দাবী ও করণীয়

০১. রোযার মাধ্যমে তাক্ওয়ার গুণ অর্জন করা 
রমযান মাসের প্রধান দাবী ও করণীয় হলো রোযা পালনের মাধ্যমে তাক্ওয়ার গুণ অর্জন করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন: হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর ফরয করা হয়েছিলো। যাতে তোমরা তাক্ওয়া বা পরহেজগারীর গুণ অর্জন করতে পারো। [সূরা আল বাকারা: ১৮২]।

০২. অশ্লীল কার্যকলাপ ত্যাগ করা 
রমাযানের বিশেষ দাবী হলো অশ্লীল কথা ও কাজ ত্যাগ করে সোনার মানুষে পরিণত হওয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি রমাযানের রোযা রাখলো অথচ অশ্লীল কথা ও কাজ এবং মূর্খতা ত্যাগ করতে পারলো না, তার এরূপ পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। [সহীহ আল বুখারী]।

০৩. কাউকে গালি-গালাজ না করা 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তোমাদের মধ্যে যে রোযা রাখলো, সে যেনো অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। যদি তার সাথে কেউ ঝগড়া-বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায় তবে তাকে বলে দিবে আমি রোযাদার। [সহীহ মুসলিম]।

০৪. পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়া 
নিজেকে পাপাচার থেকে মুক্ত করার সুবর্ণ সুযোগ হলো মাহে রমাযান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি ঈমান ও আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে রমাযানের রোযা রাখবে, তার পূর্বের গুণাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। [সহীহ আল বুখারী]।

০৫. তাওবা করা 
জীবনের জানা-অজানা, ইচ্ছা-অনিচছাকৃত সকল গুণাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, আল্লাহর কাছে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়া, ভবিষ্যতে গুনাহ না করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করাই হলো তাওবা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ঐ ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক (ধ্বংস হোক) যার কাছে রমাযান মাস এসে চলে গেলো অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করা হয়নি। [সহীহ মুসলিম]

০৬. খাদ্য মজুত না করা 
রমাযানের আরেকটি দাবী হলো, মানুষের খাদ্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য মজুত না করা। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি খাবার মজুত করে রাখবে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও রিক্তহস্ত করবেন। [সুনান ইবনু মাজাহ]। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন: যে মজুতদারী করে সে পাপীষ্ঠ। [সহীহ আল বুখারী]।

০৭. ভেজাল কারবারী না করা
ভেজাল খাদ্য ও পণ্যের ক্ষতিকর প্রভাব খুবই মারাত্মক। ভেজাল ও বিষাক্ত খাবারের টকসিন, আর্সেনিক, লেদ, মার্কারী, গোল্ড, কপারের মত পদার্থ মানুষের রক্তে মিশে যায়। কিডনি ফিল্টার করার পরও এসব বিষাক্ত পদার্থ শরীরে থেকে যায়, যা ধীরে ধীরে কিডনী ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ নষ্ট করে ফেলে। নৈতিকতা ও মানবতা বিধ্বংসী এ ঘৃণ্য কারবারী থেকে বিরত থাকা রমাযানের অন্যতম দাবী।

০৮. ধৈর্যশীল ও সমব্যাথী হওয়ার গুণ অর্জন করা 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: এ মাস ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের প্রতিদান হলো জান্নাত। এ মাস সমবেদনার মাস। [সহীহ ইবনু খুযাইমা]। মূলত রোযা মনের চাহিদা পূরণে বাঁধা দেয়ার মাধ্যমে ধৈর্য ধারণ করা এবং ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে দিন কাটানোর মাধ্যমে গরিব-অসহায়দের প্রতি সমব্যাথী হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়।

০৯. কর্মচারীদের কাজের পরিমাণ হ্রাস করা 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে তার ক্ষমতা থেকে কর্মচারীদের কাজের পরিমাণ হ্রাস করবে, আল্লাহ তাকে মাফ করে দিবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন। [শু'আবুল ঈমান]।

১০. রমাযানের সকল ফযিলাত অর্জন করা 
এ জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাযানের পূর্বেই এ মাসের তাৎপর্য তুলে ধরতেন। সালমান আল ফারসী (রা.) বলেন: শা'বানের শেষ দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণদান কালে বলেন: হে লোকসকল! তোমাদের সামনে এক মর্যাদাপূর্ণ ও বরকতময় মাস আসছে। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসে আল্লাহ রোযা ফরয করেছেন এবং রাতে দীর্ঘ নামায আদায় করাকে নফল করেছেন। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল কাজ করলো, সে যেনো অন্য মাসে একটি ফরয কাজ করলো। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয কাজ করলো, সে যেনো অন্য মাসে সত্তরটি ফরয কাজ আদায় করলো। [মিশকাত]।

১১. দানশীল হওয়া 
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন শ্রেষ্ঠ দানশীল। আর তিনি রমাযানে সবচেয়ে বেশি দান করতেন। [সহীহ মুসলিম]।

১২. রোযাদারকে ইফতার করানো 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি এ মাসে রোযাদারকে ইফতার করাবে, আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দিবেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন এবং ঐ রোযাদারের অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে, তবে তার সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না। [সহীহ ইবনু খুযাইমা]।

১৩. সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করা 
ঈদের নামাযের পূর্বেই গরিব-দুখী, অসহায় মানুষকে সাদকাতুল ফিতর প্রদান করে তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের মাধ্যমে ধনী-গরীব ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করা রমাযানের অন্যতম একটি দাবী। ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করাকে বাধ্যতামূলক করেছেন। যা একদিকে অনর্থক কথা ও কাজ দ্বারা কলুষিত রোযাকে পবিত্র করে, অন্যদিকে অসহায়-নিঃস্বকে খাদ্যদানে সহায়তা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যে ব্যক্তি সাদাকাতুল ফিতর ঈদের নামাযের পূর্বে আদায় করে, তা কবুল করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পরে আদায় করবে, তা সাধারণ সাদাকাহ হিসেবে পরিগণিত হবে। [সহীহ ইবনু খুযাইমা]।

১৪. ইতিকাফ করা 
সম্ভব হলে রমাযানের শেষ দশ দিন সকল ঝুট-ঝামেলা পিছনে ফেলে আত্মশুদ্ধি ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্যে মসজিদে অবস্থান নিয়ে ইবাদতে মশগুল হোন। বদলে যাবে আপনার জীবন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : যখন রমাযানের শেষ দশক এসে যেতো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন রাত্রি জাগরণ করতেন, পরিবারবর্গকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিতেন, লুঙ্গি শক্ত ও ভাল করে বেঁধে নিতেন। (ইবাদতে মশগুল হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন) [সহীহ মুসলিম]।

১৫. কুরআন পড়া ও কুরআন বুঝা 
কুরআন নাযিলের এ রমাযান মাসের অন্যতম দাবী হলো কুরআন অধ্যয়ন করা। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: রোযা ও কুরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে: হে আমার প্রতিপালক! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত রেখেছি, তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল করো। কুরআন বলবে: হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি, তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল করো। তিনি বলেন: অত:পর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। [মুসনাদ আহমাদ]।

অতএব, আসুন আমরা এ মহান মাসের দাবী আদায় ও করণীয় পালনের মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করি। আত্মাকে পরিমার্জিত করি। মনের মাঝে যত পাপ-পঙ্কিলতা, হিংসা-বিদ্বেষ, গর্ব, অহমিকা আর যত অসৎ গুণাবলী আছে তা ত্যাগ করি। ভাষাকে সংযত ও মার্জিত করি। খারাপ আচর-আচরণকে পরিশোধিত করি। বিশেষ করে মিথ্যা কথা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ও মিথ্যা ওয়াদা হতে নিবৃত থেকে নিজেকে একজন সৎ, সুন্দর ও সরল প্রকৃতির সাদা মনের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

অনলাইন ডেস্ক