যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (৭ ডিসেম্বর, ১৮৭৯ - ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫) ছিলেন একজন বাঙালি ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী নেতা। তিনি বাঘা যতীন নামেই সকলের কাছে সমধিক পরিচিত।
গতকাল ১০ সেপ্টেম্বর ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সর্বভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা বিপ্লবী বাঘা যতীনের ৯৭তম মৃত্যুবাষিকী। তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করছি শ্রদ্ধাঞ্জলি। ১৮৭৯ খ্রীস্টাব্দের ৮ই ডিসেম্বর বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালির গড়াই নদীর পাড়ে কয়া গ্রামে মাতুলালয়ে এই বাঙালি বীর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম জ্যোতিন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৯০৬-এর এপ্রিলে কয়া গ্রাম হতে দুই কিলোমিটার দূরে রাধারপাড়া মাঠের আখ ক্ষেতে ছুরি দিয়ে বাঘ হত্যা করে নিজকে রক্ষা করায় তাঁর নাম হয়েছিল "বাঘা যতীন।"
কয়া থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে কৃষ্ণনগরের অ্যাংলো ভার্নাকুলার হাই স্কুল হতে ১৮৯৮ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে ছাত্রাবস্থায় তিনি বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হন। ১৯০৩-এ যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের বাড়িতে বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দের সংস্পর্শে যতীন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। অতঃপর সরকারী নথিপত্রে যতীন পরিচিত হন শ্রী অরবিন্দের দক্ষিণহস্ত হিসেবে। অরবিন্দ ঘোষের সান্নিধ্যে যতীন শরীর গঠন আখড়ায় গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুগান্তর দলে কাজ করার সময় বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (ছদ্মনাম নরেন) সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং অচিরেই একে অপরের আস্থাভাজন হন।
১৯০৮-এ বাঘা যতীনসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। এ মামলার বিচারে বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে যাবজ্জীবন নির্বাসন, অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল এবং যুগান্তর সমিতিকে নিষিদ্ধ করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন এবং নরেনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁরা হাওড়া-শিবপুর এলাকায় আত্মগোপন করে অন্যান্য বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন। এরপর যতীনকে পুনরায় হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর সঙ্গে অন্যান্য যাঁরা গ্রেফতার হন তাঁদের 'যতীন গ্যাং' নামে অভিহিত করা হয়। এবার তাঁদের উপর এমন নির্মম নির্যাতন চালানো হয় যে, কয়েকজন বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করেন এবং কয়েকজন পাগল হয়ে যান। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন এ মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। জেলে থাকা অবস্থায় যতীন এবং নরেন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁরা দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দলকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং আরাধ্য উদ্দেশ্য-সাধনে সন্ন্যাসীর বেশে ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে বাংলাসহ বিভিন্ন এলাকার বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন। বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ হুগলি এবং মেদিনীপুরের বন্যার ত্রাণকার্য উপলক্ষে একত্রিত হন। তাঁরা বাঘা যতীন এবং রাসবিহারী বসুকে যথাক্রমে বাংলা এবং উত্তর ভারতের নেতা মনোনীত করেন। ভারতবর্ষের বাইরেও প্রবাসে বিপ্লবীদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। সুদূর মার্কিন মুল্লুকের সানফ্রানসিসকো শহরে যুগান্তর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শিখ সম্প্রদায় স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপের ভারতীয় বিপ্লবীগণ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে বার্লিনে সমবেত হন এবং এতে জার্মানির সাহায্য কামনা করলে জার্মান সরকার সম্মত হয়। কলকাতাস্থ জার্মান কনসাল জেনারেলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য 'ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স পার্টি' বাঘা যতীনের নিকট একজন দূত প্রেরণ করেন। ইতোমধ্যে যতীনকে বিপ্লবী দলসমূহের 'কমান্ডার-ইন-চীফ' করা হয়। যতীনকে বালেশ্বরে (উড়িষ্যা) গুপ্ত অবস্থায় রেখে বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় তথা নরেন বাটাভিয়ায় গমন করেন এবং তথায় জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাহাজে অস্ত্র প্রেরণ ও অর্থনৈতিক সাহায্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন।
পরবর্তীতে অবশ্য বৃটিশ নিরাপত্তা বাহিনী বালেশ্বরের ধানক্ষেতে যতীনের গুপ্ত আশ্রয়ের সন্ধান পায় এবং ১৯১৫-এর ৯ই সেপ্টেম্বর স্থানটি ঘেরাও করলে উভয়পক্ষে প্রচুর গোলা বিনিময় ও বন্দুক যুদ্ধের একপর্যায়ে বাঘা যতীনের সঙ্গী ফরীদপুরস্থ মাদারীপুরের বিপ্লবী চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী ঘটনাস্থলে নিহত হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মারাত্মক আহত অপর তিন সঙ্গী নীরেন দাসগুপ্ত, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও জ্যোতিষ পালসহ বাঘা যতীন গ্রেফতার হন। তাদেরকে বালেশ্বর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিত্সাধীন অবস্থায় ১৯১৫-এর ১০ই সেপ্টেম্বর বাংলা তথা ভারতবর্ষের জাতীয় বীর বিপ্লবী বাঘা যতীন শেষঃনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য যে, বাঘা যতীনের বসতভিটা কয়া গ্রামে এখনও বিদ্যমান। তবে তাঁর প্রায় সমস্ত সম্পত্তি এলাকার সম্পত্তি লোভীর দল জাল দলিলের মাধ্যমে দখল করেনিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলা তথা ভারতবর্ষের মহান সন্তান বিপ্লবী বাঘা যতীনের স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর বাস্তুভিটা ও ভূ-সম্পত্তি উদ্ধারে বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের সরকার ও জনগণের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী।
অনলাইন ডেস্ক