একঘেঁয়ে জীবনের গতানুগতিক ধারাবাহিকতা কেটে উঠতেই যেন উৎসবের বড্ড প্রয়োজন। তাইতো বিভিন্ন সামাজিক উৎসব বা অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি রয়েছে ধর্মীয় উৎসব পালনের বলিষ্ঠ বিধান। ধর্ম ভেদে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন কায়দায় তাদের ধর্মীয় উৎসবাদি পালন করে।
বিশ্ব মুসলিম হৃদয়ে আননন্দের কাড়া নেড়ে প্রতি বছরেই ঘুরে ফিরে যা উৎসব আকারে নেমে আসে তা হচ্ছে ঈদ। ঈদ আসে বছরে দু’বার। রমজানের শেষে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ আনন্দের পয়গাম নিয়ে আসে ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ। যিলহজ মাসের ১০ তারিখে ত্যগের বার্তায় উদ্ভাসিত হয়ে বছরের দ্বিতীয় দফায় যে উৎসবটি মুসলিম দোয়ারে ঠোকা দেয় তা হচ্ছে ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ। এক মাস সিয়াম সাধনার পর সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে পশ্চিমাকাশ জুড়ে বাঁকা চাঁদটি দেখার জন্য। চাঁদ দেখাতেও রয়েছে এক ভিন্নধর্মী স্বাদ ও উত্তেজনা। কারণ চাঁদের আত্মপ্রকাশের উপরই নির্ভর করে ঈদুল ফিতরের মতো একটি বিশাল মুসলিম ধর্মীয় উৎসব।
ঈদ যে কেবল একটি উৎসব তা’ নয়। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক ধরনের ইবাদতও বটে। তাই প্রতিটি মুসলিম ঘুম থেকে উঠেই গোসলাদি সম্পন্ন করে সাধ্যনুযায়ী পাকপবিত্র হয়ে ও নতুন জামাকাপড় পড়ে ঈদগাহর পানে ছুটে চলে। সেখানে ধনি-গরিব, উঁচুনিচু ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একই সারিতে দাঁড়িয়ে পরম করুণাময়য় আল্লাহতায়ালার প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও বিনম্র ভালবাসায় সিক্ত হয়ে সেজদায় লুঠিয়ে পড়ে। সত্যিকারার্থে ঈদের নামাজের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ঈদের চরম সার্থকতা। অথচ অনেক ভাগ্যপীড়িত মুসলিমকে বঞ্চিত হতে হয় এ নামাজ থেকেও।
ঈদ মানেই আনন্দ এ কথা সবার জানা থাকলেও ঈদের উল্টো পিঠে বেদনার দহনও রয়েছে। সমাজে ধনাঢ্য বিত্তশালী ব্যক্তিদের জন্য ঈদ আনন্দের সওগাত নিয়ে বয়ে বেড়ালেও অর্থ-বিত্ত হীন দরিদ্র শ্রেণীর কাছে তা আসে অনেকটা ধুসর মলিন হয়ে। মুসলিম বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশগুলোতে এ ভেদাভেদ ঈদের প্রকৃত সার্থকতাকেই যেন ক্ষুন্ন করে দেয়। জীবন যাদের কাছে অনেকটা দরিদ্র কিশোরীর ছেঁড়া কামিজের মতো, তাদের পক্ষে জাগতিক এ বিশাল উৎসবের দিনটিতেও বিষাদীয়ও হাসির ভেতর নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখা ছাড়া আর কি-ইবা করার থাকে!
আর যারা প্রবাসে থাকেন তাদের জন্যও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঈদ খুব বেশী একটা সুখকর হয়ে উঠেনা। প্রবাসে বসবাসরত বড়ো একটা অংশকেইই ঈদের এই আননদ ভাগাভাগি থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। বিশেষ এ দিনটিতেও শ্রম বিক্রির তাগাদা তাদেরকে তাড়া করে ফিরে। ফলে সকালবেলায় ঈদগাহর মাঠে যাওয়ার পরিবর্তে কর্ম ক্ষেত্রে পৌঁছাই তাদের মুখ্য হয়ে উঠে। ভাগ্যক্রমে কেউ বসদেরকে বলে কয়ে দিনটিতে ছুটি ঝুটিয়ে নিতে পারলেও নামাজ পড়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার থাকেনা। খুব বেশী পরিশ্রান্তরা ঘুমিয়ে পড়েন। কেউ বালিশ ছাপা দিয়ে বোবা কান্না কাঁদেন, কেউবা দূরালাপনিতে মা-বাবা বা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে ব্যথাতুর বুকটাকে হালকা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। আবার উৎসাহী কেউ কেউ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে আনন্দ খুজার চেষ্টা করেন। চিড়া মুড়ি যেমন ভাতের তৃপ্তি দিতে পারেনা, কৃত্রিম এ আনন্দও কখনো প্রকৃত আনন্দের স্বাদ মেটাতে পারেনা।
তবে স্ত্রী সন্তানাদি নিয়ে যারা সপরিবারে প্রবাসে বসবাস করছেন তাদের বেলায় কিছুটা আলাদা হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরাও পরিপূর্ণ স্বদেশী সুখ কখনো পাননা। দেশে পরিবার পরিজন, স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশিদের মিলনে যে মহা আনন্দের স্ফুরন ঘটে তাঁর বড্ড অভাব সেখানে। দেশে ঈদের কেনাকাটা বা নতুন জামাকাপড় নেয়ার মধ্যে যে আনন্দের মাত্রা প্রবাহমান তার কিঞ্চিৎ পরিমাণও প্রবাসে বসবাসরত মুসলিম বাঙ্গালি বা তাঁর প্রজন্মের মধ্যে বিরাজ করে বলে মনে হয়না। এ জন্য যে আবহ বা পরিবেশ প্রয়োজন তা মুসলিম অধ্যুষিত দেশ গুলো ছাড়া অন্যান্য দেশগুলোতে একেবারেই অনুপস্থিত। এর মূল কারণ হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের উৎসব মুখর ওই বিশেষ দিন গুলো এখনো এসব দেশে জাতীয় ভাবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি। যার জন্য ওই দিন গুলো সরকারী ক্যলেনণ্ডারে জাতীয় ছুটির তালিকায় লিপিবদ্ধ হতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আমার বিশ্বাস, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো মুসলিম সংখ্যা লঘু দেশগুলোতে যারা সপরিবারে বসবাস করছেন তাদের অনেকেই হয়তোবা নাগরিকত্ব পেয়ে স্থায়ী ভাবে বসবাস করার সুযোগ লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। তারপরও অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবীয় দিনের মতো ঈদের দিনে জাতীয় ছুটি (Public Holiday) না থাকায় অনেক সময় অনিচ্ছা স্বত্বেও বাধ্য হয়ে তাদেরকে কাজে যোগদান করতে হয়। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ ওই দিন গুলোতে সরকারী ছুটির (Public Holiday) দাবী জানানো এখন সময়ের দাবীতে পরিনত হয়েছে বলে আমি মনে করি।
কমিউনিটির কাজে ব্যস্ত এমন দুএকজন ব্যক্তি আজ সকালে মোবাইলে ঈদের শুভেচ্ছা মাখা এসএমএসের মাধ্যমে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়েছে। আমি তাদের এ আন্তরিকতাকে সাধুবাদ জানাই। তবে এটুকুই যথেষ্ট নয়। প্রবাসী মুসলিম হৃদয়ে প্রকৃত ঈদের সার্থকতা ফুটিয়ে তুলতে হলে দিনগুলোকে জাতীয় ছুটির আওতাধীন আনার বিকল্প নেই। আর এ দাবী নিয়ে সরকারী পর্যায়ে কমিউনিটির নেতৃ বৃন্দকেই সবার আগে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে যেসব দেশে মুসলিম কমিউনিটি বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে সে সব দেশেই প্রথমে কমিউনিটি প্রধান কতৃক এ দাবিটি উত্থাপিত হতে পারে। সে প্রেক্ষাপটে আমরা যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলিম কমিউনিটির দিকেই সবার আগে নজর দিতে পারি। ওইসব দেশে মুসলিম কমিউনিটি ভিত্তিক সংগঠন গুলো নিজেদের কর্ম যোগ্যতা ও দক্ষতা বলে অনেক এগিয়ে আছে। এমন কি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একজন বাঙ্গালি মুসলিম এম পি ও রয়েছেন যিনি চেষ্টা করলে এর ফলপ্রসুতা পাওয়া যেতে পারে অতি সহজেই। ব্রিটেন বা আমেরিকার মতো যে কোন একটি দেশে এর স্বীকৃতি মেললে বিশ্বের অন্যান্য দেশ গুলোতেও এর ধারাবাহিকতা বিস্তৃতি লাভ করবে ক্রমান্বয়ে। আর তখনি প্রবাসীরা ও তাদের নবপ্রজন্ম উত্তরসূরি পরিপূর্ণ উৎসাহ, উদ্দিপনা ও আনন্দের জোয়ারে ভেসে প্রকৃত ঈদের স্বাদ উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
লিমরিক, আয়ারল্যান্ড
১৯ আগস্ট ২০১২
এই ইমেইল ঠিকানাটি spambots থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। এটি দেখতে হলে আপনার জাভা স্ক্রিপ্ট সক্রিয় থাকতে হবে।