বইমেলায় ‘হিমু’ মানে সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নাভিশ্বাস ওঠা। পাঠকদের হুড়োহুড়ি, দীর্ঘ লাইন আর দেদার বিক্রি। এক মেলাতেই বিক্রি ছাড়িয়ে যায় লাখ কপি। কিন্তু এ হিমুটা কে? এ হলো অক্ষরে রচিত এক চরিত্র, যার স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ।
এ রকম অগণিত বইয়ের স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ এক বইয়ে লেখক সম্মানী বাবদ পেতেন ৫০ লাখ টাকা। প্রকাশকরা বই পাওয়ার জন্য দিয়ে রাখতেন অগ্রিম ১০ লাখ। সেই হুমায়ূন আহমেদের অকস্মাৎ মৃত্যুতে তার বিপুল প্রকাশনার উত্তরাধিকারী কে হবেন, সে প্রশ্নই এখন গুঞ্জরিত হচ্ছে পাঠক মহলে।
‘যখন গিয়াছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’ বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৯৪ এবং দশম সংস্করণ ২০১২। বইটির কপিরাইট গুলতেকিন আহমেদের নামে। ২০০৮-এ প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘মধ্যাহ্ন’। এ বইয়ের কপিরাইট লেখকের নিজের নামে। আবার ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘মাতাল হাওয়া’ বইটির কপিরাইট মেহের আফরোজ শাওনের নামে।
হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে ছিলেন ৬৪ বছর আর লেখকজীবন ৪০ বছরের। ২৪ বছর বয়সে তিনি ‘নন্দিত নরকে’ লেখেন এবং পরের ৪০ বছরে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩৫০ ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের কপিরাইট আইন অনুযায়ী লেখকের মৃত্যুর দিন থেকে পরবর্তী ৬০ বছর তার বৈধ উত্তরাধিকারী বইয়ের রয়্যালিটি পাওয়া থেকে শুরু করে বই-সংশ্লিষ্ট সব সিদ্ধান্তের অধিকার রাখেন। এ নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার মনজুরুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, কপিরাইটের ক্ষেত্রে বইয়ে কপিরাইট হিসেবে যে ব্যক্তির নাম উল্লেখ রয়েছে, তিনিই ওই বইয়ের বৈধ অধিকারী। এ ক্ষেত্রে যেসব বইয়ে কপিরাইট হিসেবে লেখকের নিজের নাম রয়েছে, তার বৈধ উত্তরাধিকার যিনি, তিনিই তা পাবেন। সেই বৈধ উত্তরাধিকারী কে হবেন, তা নির্ধারণ করবে তার পরিবার।
হুমায়ূন আহমেদের যেহেতু দুই পরিবার, তাই এটা কীভাবে নির্ধারিত হবে— জানতে চাইলে মনজুরুর রহমান বলেন, এ ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী তার দুই পরিবার ও সন্তানরা সমান ভাগ পাবে। অপ্রকাশিত লেখার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। যদি লেখক নির্দিষ্ট করে কাউকে বা কে কত অংশ পাবেন তা নির্ধারণ করে না দিয়ে থাকেন, তাহলে একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। প্রচলিত আইন ও ইসলামী উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী তার স্ত্রী ও সন্তানসন্ততিরা এ ভাগ পাবেন। তা ছাড়া বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সব উত্তরাধিকারীর অনুমতি ছাড়া বই প্রকাশ করলে তা আইনসঙ্গত হবে না।
হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত ৩৫০-এর বেশি বইয়ের প্রকাশকের সংখ্যা প্রায় ২৫। কোনো কোনো প্রকাশনী প্রথম দিকে তার বই প্রকাশ করলেও পরে আর করেনি বা পূর্বপ্রকাশিত বই পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো প্রকাশককে লেখক প্রকাশের দায়িত্ব দেন। এর মধ্যে সমগ্র এবং নানা প্রকার রচনার সংকলনও রয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ দুই হাতে লিখেছেন এবং পাঠকও তা গ্রহণ করেছেন উদারচিত্তে। ফলে তার প্রকাশিত বইয়ের রয়্যালিটি হিসেবেও পেয়েছেন বিপুল অঙ্কের অর্থ। তার বই সর্বোচ্চ কত কপি বিক্রি হতো, তা জানতে চাইলে তার বইয়ের এক প্রকাশক অন্বেষার স্বত্বাধিকারী মোহম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, “হিমুবিষয়ক বই বাজারে এলে এ নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যেত। আমি তার ‘হিমুর মধ্যদুপুর’ বইটি প্রকাশ করি। এ সিরিজের বই এক লাখ কপি পর্যন্ত বিক্রি হওয়ার রেকর্ড রয়েছে।”
১৯৭২ সালে খান ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস দিয়ে তিনি তার লেখকজীবন শুরু করেন। এ নিয়ে কথা হয় খান ব্রাদার্সের কেএন ফিরোজ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নন্দিত নরকে প্রকাশ করেন আমার বাবা ফজলে রাব্বী খান। প্রথম সংস্করণে ছাপা হয় ১ হাজার ২৫০ কপি। কিন্তু বিক্রি হয় ২০০-২৫০ কপি। পরের বছর কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদে তা আবার ছাপা হয়। কিন্তু পরের ১ হাজার ২৫০ কপিও শেষ হতে সময় লাগে কয়েক বছর। তবে পরবর্তী সময়ে তার বইয়ের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে।’
নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে খান ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে ৮টি, প্রতীক ৩২, অবসর ৫, অনন্যা ৩৬, সময় ৩০, কাকলি ৩৫ ও মাওলা ব্রাদার্স ১২টি। পরবর্তী সময়ে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রায় একচ্ছত্র প্রকাশক হিসেবে অন্যপ্রকাশ বের করে ১২১টি বই। এ ছাড়া অন্বেষা ২১, আফসার ব্রাদার্স ১০, পার্ল পাবলিকেশন ১২, শিখা প্রকাশনী ৩, নিউ শিখা প্রকাশনী ৬, নওরোজ প্রকাশনী ৪, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী ১৫, হাতেখড়ি ৪, সাগর পাবলিশার্স ৫, সুবর্ণ প্রকাশন ৪, অনুপম প্রকাশনী ৬, স্টুডেন্টওয়েজ ২ ও অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে ১টি বই প্রকাশিত হয়।
মেধাস্বত্ব নিয়ে কথা হলে প্রতীক ও অবসর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আলমগীর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনো আমরা কিছু জানি না। জীবদ্দশায় বইয়ের রয়্যালিটির অর্থ সবসময় লেখকই পেতেন। তার অবর্তমানে কপিরাইট কে পাবেন তার নাম লেখা আছে। এ ব্যাপারে তার পরিবার সিদ্ধান্ত নেবে। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমরা রয়্যালিটি দেব।’
অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম জানান, এ পরিস্থিতিতে কথা বলা মুশকিল। এখনো ধকল কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। মানসিকভাবে খানিকটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর এ নিয়ে তিনি কথা বলবেন।
অন্বেষার প্রকাশক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনের কাছে তার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের স্বত্ব্বাধিকারী কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সব বইয়েরই স্বত্ব শাওন আপুর নামে।’
এ বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই রম্য লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদের উত্তরাধিকারী তো তার ছয় ছেলেমেয়ে। আইন অনুযায়ী, যে বা যারা এর প্রাপ্য হবে, সে বা তারাই লেখার রয়্যালিটি পাবে।
অনলাইন ডেস্ক