রাজনৈতিক সংকটে থাকা আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ ধাক্কা লেগেছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, কভিড-১৯ সংকটের কারণে অর্থনীতিতে যে অভিঘাত এসেছে তা অতীতের অন্য যে কোনো সময়ের অর্থনৈতিক সংকটের তুলনায় মৌলিকভাবেই ভিন্ন।

এরফলে আয়ারল্যান্ডে ব্যাপকহারে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাজার পরিষেবা খাত, শ্রমঘন খাত যেমন: খুচরা ব্যবসা, খাদ্য ও পানীয় ব্যবসা এবং আবাসন, পর্যটন ও ভ্রমণ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর গ্যাব্রিয়েল মাখলুফ বলেছেন, কভিড-১৯ আইরিশ অর্থনীতিকে নজিরবিহীন সংকটে ফেলেছে। এ মহামরি যত দীর্ঘায়িত হবে, আয়ারল্যান্ডের অর্থনৈতিক সংকটও ততই প্রলম্বিত হবে। তিনি বলেছেন, আমরা সবে এসব চ্যালেঞ্জ দেখতে শুরু করেছি। আয়ারলান্ডে আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, আয়ারল্যান্ড দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে সক্ষম হলেও তা যথেষ্ট নয়। কারণ অন্যান্য দেশ করোনার বিস্তার রোধে কতটা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসাটাও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আয়ারল্যান্ডের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে। চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট হলে অর্থনৈতিক জটিলতা আরও বাড়বে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অধীনে ব্রিটেন ও ইইউর মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি হলে তা আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতির জন্য জটিলতা তৈরি করবে।

এদিকে আইরিশ ফিসক্যাল অ্যাডভাইরজরি কাউন্সিল বলেছে, দেশটির অর্থনীতি আবার করোনাপূর্ব সময়ে ফিরে আসতে সাড়ে তিন বছর সময় লেগে যেতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস হলো তৃতীয় প্রান্তিকে বেকারত্বের হার পৌঁছবে ২৫ শতাংশে যা প্রথম প্রান্তিকে ছিল মাত্র ৫ ভাগ। এর মানে হলো সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ লোক চাকরি হারাবে। বছরের শেষার্ধে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে ধরে নিয়ে ব্যাংক বলেছে, তৃতীয় প্রান্তিকে বেকারত্বের হার ১৫ শতাংশে এবং শেষ প্রান্তিকে তা ১২ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে।

করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল তাতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে এবং ভোগও কমেছে। এতে চলতি বছর জিডিপির আকার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে। জুনের পরও কড়াকড়ি বহাল রাখা হলে জিডিপি সংকোচনের হার ১৫ শতাংশে পৌঁছতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে সরকারের দুই হাজার ১৮০ কোটি ইউরো ক্ষতি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে আয় বৃদ্ধি ও ব্যবসায়ীদের জন্য ৮২০ কোটি ইউরো খরচ এবং ১৩৬০ কোটি ইউরো কর আদায় না হওয়া এবং জনকল্যাণে অতিরিক্ত ব্যয়। এরফলে ২০২০ সালে আইরিশ সরকারের বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে ১৯৬০ কোটি ইউরোতে। অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল ২২০ কোটি উদ্ধত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, করোনাভাইরাসের ব্যাপকতা এখনো স্পষ্ট না হওয়ায় তাদের এই আর্থিক প্রাক্কলন নিয়েও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা রয়েছে। ভোগ ও বিনিয়োগের সম্ভাব্য হ্রাসের ফলে এই অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান বিভাগের পরিচালক মার্ক ক্যাসিডি বলেছেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার নির্ভর করছে মহামারিতে লোকজন কতটা শঙ্কিত হয়েছে, চাকরি ও আয় পুনরুদ্ধার এবং সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের ওপর। তবে এই অর্থনৈতিক সংকটকে তিনি মহামন্দার সঙ্গে তুলনা করতে চান না। কারণ মহামন্দা হলো কর্মসংস্থান ও আয়ের দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়া।

আরেকজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, কারোনাভাইরাসের প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা থাকলেও আয়ারল্যান্ডে ২০০৮ সালের মত ব্যয় সংকোচন করতে হবে না। এর কারণ এবার দেশের অর্থনীতি অনেক ভালো অবস্থায় আছে। এই সংকট যখন শুরু হয় তখন অর্থনীতি ছিল অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ, সরকারি ব্যয় ছিল নিয়ন্ত্রিত, সরকারের ঋণ কমতে ছিল এবং রিজার্ভসহ বাজেট ছিল উদ্ধৃত।

আয়ারল্যান্ডে গত এপ্রিলে বেকার সুবিধা অথবা বেতনে ভতুর্কির দাবি মার্চ মাসের তুলনায় বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। মোট পাঁচ লাখ ১৩ হাজার ৩৫০ জন এ ধরনের সহায়তা চেয়েছে। এটা দেশটির মোট শ্রমশক্তির এক পঞ্চমাংশ। এক দশক আগে মন্দার সময়ও এতো লোক এ ধরনের সুবিধা চায়নি।

প্রথম প্রান্তিকে সরকারের রাজস্ব আহরণ টার্গেটের চেয়ে ৮০ কোটি ইউরো কম হয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর কারণ ভ্যাট রিটার্ন দাখিল কার্যত ভেঙে পড়েছে। ভোগ কমে যাওয়ায় বিক্রি কর ৫০ শতাংশ কমে গেছে। অর্থমন্ত্রী পাশকল ডোনোহো সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে সরকারের রাজস্ব আয় সামনের মাসগুলোতে ব্যাপকভাবে কমতে থাকবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, দেশের ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো যদি বাইরের অর্থ সহায়তা চায় এবং তাদের বেতন বহির্ভূত ব্যয় ৫০ শতাংশ হ্রাসও করে, তা সত্ত্বেও তাদের ৫৭০ কোটি ইউরো সহায়তা দরকার।

গত ফেব্রুয়া‌রি‌তে আয়ারল্যান্ডের নির্বাচন হলেও এতে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে স্থায়ী সরকার গঠ‌নের প্রক্রিয়ায় বিলম্বতা দেখা য়ায়। এর মধ্যে যোগ হয় কো‌ভিড-১৯। দেশটি গত কয়েকমাস তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর শাসনে চললেও ভিতরে ভিতরে জোট সরকারের গঠন প্রণালী নিয়ে ‌তিন‌টি দলের ম‌ধ্যে আলোচনা অব‌্যাহত ছিল।

সকল জল্পনা - কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সর্বশেষ গত সপ্তাহে তিনটি রাজনৈতিক দল জোট সরকার গঠনের চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। এ দলগুলো হলো ফিনা ফল, ফিনা গেইল ও গ্রিন পাটি। তবে বিশেষভাবে উ‌ল্লেখ‌্য যে গত নির্বাচনে টপ স্কোরার শিন ফিন অপ্রত‌্যা‌শিত ভাবে সরকার গঠনের দৌঁড় থেকে ছিটকে পড়ে। সম্প্রতি নির্বাচন পরবর্তী প্রথম এক জরিপে দেখা গেছে যে করোনা মহামারী শক্তভাবে মোকা‌বেলা করার কারণে তত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী লিও ভারদাকারের দল ফিনে গেইলের জন‌প্রিয়তা কিছুটা বৃ‌দ্ধি পেয়েছে। বর্তমান জোট সরকারের অন‌্যতম রাজনৈতিক দল ফিনা ফলের পূর্বের অবস্থান নিজেদের দখলে রাখলেও জোটের তৃতীয় বৃহৎ শরীক দল গ্রীন পা‌র্টির জন‌প্রিয়তা কিছুটা কমেছে।

রাজনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠার সাথে দেশটির করোনা বিপর্যস্ত অর্থনীতি আগের অবস্থায় ফিরি‌য়ে আনা হবে সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। আশার কথা হচ্ছে ইউরোপের করোনা ভাইরাসের প্রকোপ অনেক দেশে কমে আসছে। আয়ারল্যান্ড এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠার পথে রয়েছে। সে ক্ষেত্রে দেশ‌টি হয়ে উঠতে পারে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। পর্যটন ছাড়া আয়ারল্যান্ড নলেজ ইকোনমির দেশ। হাইটেক, লাইফ সাইন্স ও ফিনান্সিয়াল সার্ভিস সেক্টর ও কৃষির ওপর ভিত্তি করে এ দেশের অর্থনীতি দাড়িয়ে আছে। বিশ্বের এভিয়েশন সেক্টরে আয়ারল্যান্ড প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। করোনা ভাইরাসে এভিয়েশন খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমে আসার সাথে সাথে এর সুফল আয়ারল্যান্ড পাবে।

এখন দেখার বিষয় করোনার ধাক্কা কা‌টি‌য়ে উঠার লক্ষ্যে নতুন জোট সরকার কিভাবে তাদের অর্থনৈতক পরিকল্পনা সাজায়।

লেখকঃ সৈয়দ আতিকুর রব
অনলাইন একটিভিস্ট ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
আয়ারল্যান্ড প্রবাসী