হার্ট-স্ট্রোক (হৃদপিন্ডের যে কোন ধরনের হুমকি/ তাড়ন/ প্রদাহ) অর্থাৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে হার্ট-এটাক বলা হয় এবং সেই সাথে ব্রেইন-স্ট্রোকের কথা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপের রোগী ও বয়স্করা এসব নিয়ে
বেশ আতঙ্কে থাকেন। কিন্তু হার্ট-স্ট্রোক/ এটাক এবং ব্রেইন-স্ট্রোক ছাড়াও আরেক ধরনের স্ট্রোক আছে যার কথা আজ আপনাদের বলতে চাই। এটি মূলত চরম ও গরম আবহাওয়া জনিত সমস্যা। গরম অঞ্চল এবং বিশেষ করে যে সব স্থানের আর্দ্রতা বেশি, সেসব অঞ্চলের মানুষ প্রায়ই এই স্ট্রোকের শিকার হন। এর নাম হিট-স্ট্রোক অর্থাৎ সর্দিগর্মি। গরমের দিনে প্রচন্ড রোদে অফিস আদালতে যাবার পথে কিংবা হাটে-বাজারে ও বিশেষ করে যেসব এলাকায় রাস্তার পাশে গাছ-পালা খুবই কম, পথ চলতে চলতে হঠাৎ করে নিজে বা অন্য কেউ এতে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। এটি চিকিৎসা বিষয়ক একটি জরুরী অবস্থা এবং জীবনের জন্য হুমকি বটে। তবে তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নিলে খুব সহজেই এটির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই নিজেকে ও অপরকে এই বিপদের হাত থেকে রক্ষার স্বার্থে সহজ কিছু কৌশল জানা থাকলে তা সবার জন্যই ভাল।
হিট-স্ট্রোক সম্পর্কে বলার পূর্বে আরেকটি সমস্যার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কখনো কখনো অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারনে প্রচন্ডভাবে ঘেমে যাওয়ার ফলে রক্তচাপ বেশ নিচে নেমে গিয়ে চরম পরিশ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। একে হিট-এক্সাশ্শান বলে। অনেক সময় এর উপসর্গগুলো দেখে এ অবস্থাকে হার্ট-স্ট্রোক (হৃদপিন্ডের কোনরূপ হুমকি/ তাড়ন/ প্রদাহ) বলে ভুল হতে পারে। শুধু গরমের সময়েই যে মানুষ এতে আক্রান্ত হয় তা নয়। যে কোন সময়েই এমনটি হতে পারে। তবে গরম কালে হঠাৎ করে শরীরচর্চা বন্ধ করে দিলেও এমনটি ঘটতে পারে।
হিট-এক্সাশ্শান এর কয়েকটি উপসর্গ নিচে দেয়া হলো:
১/ বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া
২/ ক্লান্তি বা অবসাদ
৩/ দুর্বল হয়ে পড়া
৪/ মাথাব্যথা
৫/ মাংসপেশিতে আক্ষেপ বা বেদনা
৬/ মাথা ঘোরা ভাব
৭/ এক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা সাধারনত ৩৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেটে/ ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইটে উঠতে পারে। তবে কখনই ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেট/ (১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইটের বেশি হবে না।
৮/ এ সময় শরীরের ত্বক সাধারনত আর্দ্র ও সেঁতসেঁতে থাকে।
৯/ চোখের তারারন্ধ্র প্রসারিত থাকে।
৯/ মানসিক অবস্থা ও আচরণ স্বাভাবিক থাকে।
হিট-এক্সাশ্শানে আক্রান্ত হলে তার প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে যা করতে হবে:
১/ আক্রন্ত ব্যক্তিকে ঠান্ডা স্থানে চিত হয়ে শুয়ে পড়তে হবে।
২/ পা দুটি ও নিতম্ব কিছুটা উপরে তুলে রাখতে হবে।
৩/ পিপাসা না থাকলেও ঘন ঘন পানি পান করতে হবে।
এই ব্যবস্থাগুলো নিলেই হিট-এক্সাশ্শানের উপসর্গগুলো কমে আসবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবেন- ইনশাল্লাহ।
এবার আসল প্রসঙ্গে আসা যাক:
হিট-স্ট্রোকঃ কোন কারনে দেহের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে শরীরিক কিছু লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে স্নায়ু-তন্ত্রেরও কতিপয় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়- সংক্ষেপে একে হিট-স্ট্রোক বলে।
স্বাভাবিক অবস্থায় বিপাকীয় কার্যের ফলে আমাদের শরীরে যে তাপ উৎপন্ন হয় তা শরীরের ত্বকের মাধ্যমে বিকিরিত হয়ে কিংবা ঘামের বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় দেহ থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু অত্যাধিক গরমে, উচ্চ আর্দ্রতায়, কিংবা প্রচন্ড রোদে অত্যাধিক শারীরিক পরিশ্রম করলে অনেক সময় এই তাপ শরীর থেকে বের হতে পারে না। ফলে দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং দেহের মধ্যকার তন্ত্রগুলোর বন্ধদাশা শুরু হয় অর্থাৎ এগুলো কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে। এছাড়া ডিহাইড্রেশন বা নির্জলীভবন হলে অর্থাৎ কোন কারনে দেহ থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে গেলেও হিট-স্ট্রোক হতে পারে।
হিট-স্ট্রোক মূলত দু-ধরনের:
১/ ক্ল্যাসিকাল বা চিরায়ত হিট-স্ট্রোক
২/ এর্ক্সাসাইজ -ইনডিউস্ড বা শরীরচর্চা/পরিশ্রম জনিত হিট-স্ট্রোক।
ক্ল্যাসিকাল বা চিরায়ত হিট-স্ট্রোকঃ কোনরূপ শারীরিক পরিশ্রম ছাড়াই মূলত তাপপ্রবাহের কারনে মানুষ এতে আক্রান্ত হয়।
এ ধরনের হিট স্ট্রোকের প্রতি যারা অত্যন্ত সংবেদনশীল:
১/ শিশুরা, বিশেষ করে প্রচন্ড রোদে যানবাহনে অবস্থানরত শিশুরা।
২/ বৃদ্ধরা, বিশেষ করে যারা হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্র বা কিডনী রোগে ভুগছেন।
৩/ যারা এমন ধরনের ওষুধ সেবন করছেন যা শরীর থেকে পানি বের করে দিয়ে ডিহাইড্রেশনের মত অবস্থার কারন হতে পারে।
এর্ক্সাসাইজ-ইনডিউস্ড বা শরীরচর্চা জনিত হিট-স্ট্রোকঃ যারা গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় শারীরিক পরিশ্রম করেন তারাই মূলত এতে বেশি আক্রান্ত হন।
এ ধরনের হিট স্ট্রোকের প্রতি যারা অত্যন্ত সংবেদনশীল:
১/ তরুণ ও স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের মধ্যে যাদেরকে বেশিরভাগ সময়ে বাহিরে অর্থাৎ প্রচন্ড রোদে কাজ করতে হয় তারাই এতে ভোগেন বেশি।
২/ সুস্থ-সবল ক্রীড়াবিদ, যারা অল্প সময়ে অত্যাধিক পরিশ্রম করেন, বিশেষ করে ম্যারাথন দৌড় অপেক্ষা স্বল্প দূরত্বের দৌড়ে (৫ - ৬ কিমি) যারা অংশ নেন তাদের জন্য এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
কারো কারো ক্ষেত্রে হিট-স্ট্রোক এর আলামত বা লক্ষণগুলো হঠাৎ করে এবং বেশ দ্রুত প্রকাশ পেতে পারে। তবে সবার ক্ষেত্রেই যে লক্ষণগুলো একই রকম হবে তা নয়। বিভিন্ন জনের বেলায় বিভিন্নভাবে তা প্রকাশ পেতে পারে।
হিট-স্ট্রোকের বেশ কিছু সাধারণ উপসর্গ রয়েছে, যা দেখে এটি নির্ণয় করা সহজ হয়:
১/ শরীরের তাপমাত্রা অত্যন্ত বেড়ে যাওয়া (পায়ু পথে ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড/ ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট হতে ৪১ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড/ ১০৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট কিংবা কখনো কখনো আরও বেশি হতে পারে)।
২/ ঘাম না হওয়ায় গায়ের ত্বক তপ্ত, শুষ্ক ও লাল হয়ে ওঠা।
৪/ নাড়ীর স্পন্দন বেড়ে যাওয়া।
৫/ শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হওয়া।
৬/ অস্বাভাবিক আচরণ করা।
৭/ দৃষ্টিভ্রম অর্থাৎ কল্পিত কিছু দেখার অভিব্যক্তি প্রকাশ করা।
৮/ বিভ্রান্তি বা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার সৃষ্টি হওয়া।
৮/ উত্তেজিত বা অস্থির ভাব প্রকাশ পাওয়া।
৯/ খিঁচুনি হওয়া।
১০/ গাঢ় নিদ্রাচ্ছন্নতা বা অচেতন হয়ে যাওয়া।
১১/ চোখের তারারন্ধ্র সংকুচিত হয়ে আসা।
হিট-স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়:
১/ গ্রীষ্ম কালে অতিরীক্ত ঘাম হয়। তাই কিছুক্ষণ পর পর বিশুদ্ধ পানি, ডাবের পানি, সরবত, ফলের জুছ ইত্যাদি পান করতে হবে।
২/ যারা হাইপোটেনশনে ভুগছেন অর্থাৎ যাদের লো-ব্লাডপ্রেশারের টেনডেন্সি রয়েছে তাদের জন্য আহারের সময় সামান্য পরিমাণে কাচা লবন খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। বেশ দূর্বল লাগলে তারা মাঝে মাঝে খাবার স্যালাইনও খেতে পারেন।
৩/ প্রচন্ড রোদে একনাগারে বেশি সময় ধরে পরিশ্রম ও ভারি কাজ না করে মাঝে মাঝে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে হবে।
৪/ তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়ায় কাজে বের হলে সাদা বা হালকা রঙের পোষাক পরিধান করা উচিত।
৫/ বেশি সময়ের জন্য রোদে বের হলে সঙ্গে ছাতা রাখতে হবে।
৬/ অসহ্য গরমে দিনে দু-তিন বার গোসল করলেও আরাম মিলবে এবং সার্দিগর্মির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
৭/ প্রচন্ড রোদে রাস্তা-ঘাটে চলাফেরার সময় মাঝে মাঝে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয়ার পাশাপাশি পানি পান করতে হবে।
হিট-স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তার প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে যা করতে হবে:
১/ আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত ছায়াঘেরা ঠান্ডা স্থানে নিয়ে আসতে হবে।
২/ তাকে চিত করে শুইয়ে পা-দুটি ও নিতম্ব কিছুটা উঁচুতে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
২/ ফ্যানের নিচে কিংবা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে নিতে পারলে আরও ভাল হয়।
৩/ যথাসম্ভব শরীরের কাপড় খুলে ঠান্ডা পানি ঢালতে হবে অথবা বড় তোয়ালে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে সমস্ত শরীর স্পঞ্জ করে দিতে হবে।
৪/ বগল বা দুই উরুর খাঁজে কিছুক্ষণ আইস-ব্যাগ রাখা যেতে পারে।
৫/ খেতে পারলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঘন ঘন পানি ও তরল খাবার দিতে হবে।
৬/ মাঝে মাঝে শরীরের তাপমাত্রা মেপে দিখতে হবে এবং ১০১ থেকে ১০২ ডিগ্রী ফারেনহাইটে না নামা পর্যন্ত ঠান্ডা করার প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে।
***সব সময় মনে রাখতে হবে- হিট-স্ট্রোক এক প্রকার মেডিকেল এমার্জেন্সি। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বাঁচানোর স্বার্থে যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। আক্রান্ত ব্যক্তি মুখে খেতে না পারলে ও শরীরের তাপমাত্রা কিছুতেই না কমলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সমস্যাটি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে