মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিপূর্ণ যুবক-যুবতীদের বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে কাজের খোঁজে ইউরোপ-আমেরিকায় চলে যাওয়া প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। ‘ব্রেইন ড্রেন' বা মেধা পাচারের এই ঘটনাগুলো আরব দেশগুলোর অর্থনীতির জন্য দুর্যোগের কারণ হয়ে ওঠে।

বহু আরব দেশ এখনো এই যন্ত্রণায় ভুগছে। ইদানীং আরব ছাত্রছাত্রী ও তরুণ স্নাতকদের মানসিকতায় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। গুগল বা ইয়াহুতে কাজ করার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে নিজেদের দেশে উদ্ভাবনমূলক কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালনে তাদের আগ্রহ ইদানীং স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের তরুণ পেশাজীবীরা নিজেদের সৃজনক্ষমতার ও কারিগরি দক্ষতার স্বাক্ষর স্বদেশে স্থাপন করে দেখাতে চায়। ব্রেইন ড্রেনের বিপরীতমূখী হাওয়া ইদানীং বইতে শুরু করেছে লিবিয়া থেকে শুরু করে লেবানন পর্যন্ত। প্রতিভাদীপ্ত তরুণেরা বিদেশ থেকে ফিরে আসতে শুরু করেছে স্বদেশে।

নতুন প্রজন্মের এই উদ্যমী প্রতিভাবানেরা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে চায় যে, স্বদেশের পরিবেশেই সৃজনশীলতায় তৎপর থাকা সম্ভব। হিন্দ্ হোবেইকা হচ্ছেন এই তরুণ আবরদের প্রতিনিধি স্থানীয় একজন। এই লেবানীজ তরুণীর বৈপ্লবিক উদ্ভাবন এমআইটি এন্টারপ্রাইজ ফোরাম প্যান আরব বিজিনেস প্ল্যান কমপিটিশনে তাকে এনে দিয়েছে সাফল্যের প্রথম স্থানটি। সাঁতারকালে ব্যবহার্য ‘বাটার ফ্লাই' নামের তার উদ্ভাবিত অভিনব গগ্লস্ প্রশিক্ষণরত সাঁতারুকে তার হৃৎ-স্পন্দন গুণতে সাহায্য করবে।

আর্থিক বিশ্বায়নের পটভূমিতে দেশ বিশেষের একক বিচ্ছিন্ন বসবাস বর্তমান বিশ্বে অসম্ভব। উদ্ভাবিত পণ্যের পরিচিতি স্থাপনের এবং বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য দেশান্তরী হওয়ার দরকার আজকাল ফুরিয়ে গেছে। বদলে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বিন্যাস। বিশ্বমন্দার সবচেয়ে প্রখর প্রহার পড়েছে পাশ্চাত্যের অর্থনীতিতে। রোজগার সৃজন বর্তমানে শুরু হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত আরব দেশগুলোয় পুঁজি, প্রযুক্তি ও শিল্পোদ্যমের সমাহার ক্ষেত্র হচ্ছে এদেশগুলো বর্তমানে।

আরব বিশ্বজুড়ে নবীন শিল্পোদ্যোগীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে টিভি স্টেশনসহ অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠানকে। কাতার ফাউন্ডেশনের মদদপুষ্ট স্টোর অব সায়েন্স প্রদর্শনীতে প্রতিযোগী হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন হোবেইকা। স্টার অব সায়েন্স প্রতিযোগিতার চলমান চতুর্থ পর্বে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা হচ্ছে নতুন প্রজন্মের তরুণ আরব সৃজনশীল প্রতিভাবানদের। নতুন শিল্পোদ্যোগীরা আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন বৈরুতের, আম্মানের ও কায়রোর তাহরির স্কোয়ার-ওয়েসিস নামের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।

বিশ্বে প্রথম আরবি-ইংলিশ ই-মেইল সার্ভিস সরবরাহকারীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত জর্দানী মাকতূব প্রতিষ্ঠা করেন সামিহ্ তুকান ১৯৯৮ সালে। পরে ২০০৯ সালে ইয়াহু এর স্বত্ব কিনে নেয়। অতি সম্প্রতি ইরাকী বংশোদ্ভুত ইহসান জাওয়াদ ‘জাওইয়া' নামের যে বিজিনেস ইনফর্মেশন সার্ভিসটি চালু করেন, টম্পস্ন্ রয়টার্স কর্পোরেশন তা কিনে নেয়ায় সেটিও খ্যাতিমানদের তালিকায় শামিল হয়ে যায়। প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে আর এক নবাগতের নাম হচ্ছে বৈরুতের সিনেমোজ।

চলচ্চিত্রশিল্পে বিজ্ঞাপন শিল্পে, তথা ওয়েব ও মোবাইল প্রযুক্তি ক্ষেত্রের একদল লেবানীজে পেশাজীবীর দ্বারা স্থাপিত সিনেমোজ বর্তমানে পরিণত হয়েছে আরব বিশ্বে প্রথম অন-ডিম্যান্ড অনলাইন ভিডিও প্লাটফর্মে। শিক্ষিত যুবকদের জন্য রোজগার সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং শুধুমাত্র তেল রফতানির আয়ের ওপর নির্ভরতা হ্রাসের লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের ওপর ভিত্তিশীল আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রয়োজন পূরণে ব্যস্ত রয়েছে বর্তমান আরব বিশ্ব। এ ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের উদ্যমী ও উদ্যোগী তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিশেষভাবে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে এই নতুন প্রজন্মকে সহায়তা দিতে আরব সমাজ ও সরকারগুলোর প্রশংসনীয় সক্রিয় ভূমিকা কারুর দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না।

সংযুক্তি আরব আমিরাতের এই লক্ষ্যে গৃহীত অগ্রসর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখনীয় সারা আরব বিশ্বে নববিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নতুন প্রজন্ম যে উদ্যম ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তার সুনিশ্চিত পরিণাম স্বরূপ পরিবর্তনের প্রবাহে প্রবেশ করবেন মুষ্টিমেয় ক'জন আরব তরুণমাত্র নন, বরং বলা যায় শতক-পুঞ্জিত স্থবিরতা বিসর্জন দিয়ে সারা আরব বিশ্ব এগিয়ে যাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আলোকে উদ্ভাসিত এক নতুন বিশ্বে।

অনলাইন ডেস্ক