কথায় আছে, কাজ দিয়ে কাজী। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে এমপি, মন্ত্রী-মিনিস্টার যাই বলিনা কেনো যদি তাদের মাধ্যমে সমাজে দৃশ্যমান কোনো কাজ প্রতিফলিত না হয় তাহলে সেই পদ পদবির যেমন মূল্য থাকেনা তেমনি সমাজে তা গুরুত্বও বহন করেনা।

সাময়িক আখের গোছানোর জন্য এসব পদ ফলপ্রসূ হয় বটে কিন্তু মানুষের হৃদয়ে ব্যক্তিসত্বাটা খূব বেশি দিন বেঁচে থাকেনা। আবার কেউ কেউ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সততা ও নীতিবোধের ধোঁয়া তোলে সামাজিক কর্মকাণ্ড ও ব্যক্তি পর্যায়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকেন। এতে শুধু সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হয়না, নিজেকেও এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়।

আমার এলাকার একজন মন্ত্রীর কথা বলি। আব্দুল মমিন। বঙ্গবন্ধুর আমলের খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী। খুব সৎ লোক ছিলেন। আমাদের উপজেলায় (মোহনগন্জ) তাদের দান দক্ষিনার শেষ নেই। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে ট্রেন স্টেশন, বাজার অনেক কিছুই তাদের জায়গায় গড়ে উঠেছে। সবই ঠিক আছে। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্বেও তিনি কাজ করতেননা। এলাকার লোকজন তার কাছে কোনো কাজকাম নিয়ে গেলে বলতেন, "আমি তো শুধু ওই এলাকার মন্ত্রী নই, সারা বাংলাদেশের মন্ত্রী"।

তিনি যথার্থই বলতেন, "সারা বাংলাদেশের মন্ত্রী"। কিন্তু যাদের ভোটে তিনি এমপি হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন তাদেরকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা তার উচিত ছিলো। তা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই পরবর্তীতে লুৎফুজ্জামান বাবরের মতো এক রাজনৈতিক নবজাতকের কাছে (সাবেক সরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) নেত্রকোনা ৪ আসনে দু দুবার শোচনীয় ভাবে পরাজয় বরণ করেন। একজন মন্ত্রী গোটা দেশ নিয়ে ভাববেন তাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিজ এলাকা তো আর দেশের বাইরে নয়। নিজেকে ভালো রাখার অর্থই হচ্ছে অন্যকে ভালো রাখা। সে অর্থে নিজ এলাকার কাজ করা, উন্নয়ন ঘটানোর অর্থই হচ্ছে দেশের উন্নয়ন। তিনি যদি বাপদাদার দান দক্ষিনা আর কট্টর নীতিবোধের খামে নিজেকে ভরে না রাখতেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনীতি করুয়া এমন একজন প্রাজ্ঞ মানুষকে বাবরের মতো অখ্যাত কোনো প্রার্থীর সাথে এভাবে ধরাশায়ী হতে হতোনা। তাঁর এ পরাজয় শুধু তাকেই ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়নি, এজন্য তাঁর দল, দেশ ও সমাজকে যে বেশ মূল্য দিতে হয়েছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সুতরাং রাজনীতি করতে হলে, সমাজ সেবা করতে হলে, নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সবার আগে জনগণের পালস বুঝতে হবে। জনগণ কি চায়, তাদের চাহিদা কি, তারা কোন ডাইমেনশনে আছে তা উপলব্ধি করে যারা সামনের দিকে এগিয়ে যায় তাঁরা নিজেদেরকে যেমন ইতিহাসে দাড় করতে সক্ষম হয় তেমনি সমাজের জন্যও বয়ে আনে বহুমুখী কল্যাণ। আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত এমন একজন কর্ম পাগল বাঙ্গালির আবির্ভাব ঘটেছে ধ্রুব তারার মতো।

আজাদ তালুকদার। লিমরিক সিটি কাউন্সিলের (ওয়েস্ট) একজন সম্মানিত সদস্য। ওয়ার্কপারমিটে বারম্যান হিসেবে তার এ দেশে আগমণ। কিন্তু মানুষের জন্য কিছু করার চিন্তা ভাবনা তাকে তাড়া করে বেড়াতো। সে উপলব্ধি থেকেই তিনি একসময় স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কিছু দিন লেবার পার্টিতে (Labour Party) কাজ করলেও পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশের বৃহৎ দল ফিনাফলে (Fianna Fail) যোগদান করেন। এ দল থেকেই ২০১৯ সালের মে মাসে গৌরবের সাথে কাউন্সিলের হিসেবে নির্বাচিত হন।

যে লোক একদিন শুধুমাত্র জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়ে পরবাসে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি আজ সেই পরবাসেই স্থানীয়দের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজের স্থান দখল করে নিয়েছেন। একজন বারটেন্ডার যিনি ড্রিংস পরিবেশন করতেন, টেবিল থেকে গ্লাস কুড়িয়ে আনতেন তিনি আজ এ সমাজের একজন কর্ণধার। তার সততা, কর্মস্পৃহা ও কর্মে শ্রদ্ধাবোধ, আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় তাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

তিনি যে একজন দক্ষ ও সফল কাউন্সিলর তা অতি অল্প সময়েই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। অতি সম্প্রতি আইরিশ পার্লামেন্টে টিডি (আয়ারল্যান্ডে সাংসদকে TD বলা হয়) নাইল কলিন্স তার ভূয়সী প্রশংসা করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা থেকে খুব সহজেই তা অনুমান করা যায়। তিনি রেসিজমের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। মাইগ্রেন্ট কমিউনিটি যাতে স্থানীয় সমাজব্যবস্থায় আরও বেশি ভূমিকা ও অংশীদারিত্ব বজায় রাখতে পারে সেজন্য তাদেরকে অধিকতর সুযোগ সুবিধা প্রদানের দাবিও তার বক্তব্যে ফুটে ওঠে। মাইগ্রেন্ট কমিউনিটির কেউ সুযোগ ও দায়িত্ব পেলে তারা যে অনেক ভালো করতে পারে সেটা তিনি তুলে ধরেন এভাবে, "We had a good candidate elected in Limerick city, Councillor Azad Talukder who came from Bangladesh has done great work in promoting and seeking integrity at migrant community and will become Deputy Mayor of Limerick city and county. এ বক্তব্যে অতি শীঘ্রই আজাদ তালুকদারের ডেপুটি মেয়র হওয়ার যেমন গৌরবময় বার্তা রয়েছে তেমনি তিনি সম্মানের সাথে বাংলাদেশকে আইরিশ পার্লামেন্টে তুলে ধরে আমাদের সুনাম ও গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ চিত্তে মি কলিন্সকে জানাই আন্তরিক অভিবাদন ও ধন্যবাদ।

কাউন্সিলর হিসেবে আজাদ তালুকদার তার সাফল্যের খাতায় আরেকটি নতুন বিষয় যোগ করেছেন অতি সম্প্রতি। মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র কবরস্থান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লিমরিক কাউন্টি কাউন্সিলের বাজেট থেকে একটি তহবিল আদায় করতে সক্ষম হন এ সার্থক মানুষটি। তাঁর সাথে কথা বলে জানা গেছে, কবরস্থান নির্মানে কাউন্সিল ৫০,০০০ ইউরো প্রদান করতে রাজি হয়েছে। এ অর্থ অনুদানের মধ্য দিয়ে এটি স্বীকৃতি পেল যে, আয়ারল্যান্ডে মুসলিমদের জন্য আলাদা কবরস্থান নির্মানে আর কোনো রকমের বাধা নিষেধ রইলো না।

একটি অমুসলিম দেশে মুসলিমদের কবরস্থান নির্মানের জন্য বাজেট পাস করিয়ে আনার কাজটি মোটেও ছেলের হাতে মোয়া নয়। আভ্যন্তরীণ কূটচাল ও বিভিন্ন বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে স্বীয় প্রজ্ঞা, মেধা, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও দূরদর্শিতার মাধ্যমেই কেবল তিনি কাজটি বাগিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। জনাব তালুকদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কবরস্থান বিষয়ক তার প্রস্তাবটি আলোচনার টেবিলে আসতেই অধিকাংশ কাউন্সিলর এতে দ্বিমত পোষণ করেন। কিন্তু তালুকদার সাহেব থেমে থাকার মানুষ নন। তিনি তার রাজনৈতিক কৌশল ও বলিষ্ঠ যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদেরকে রাজি করাতে সচেষ্ট হন। প্রাথমিক পর্যায়ে কাউন্সিলের কিছু সদস্য অসম্মতি জ্ঞাপন করলেও পরিশেষে তাঁরা মতৈক্য প্রকাশের মাধ্যমে যে উদারতা দেখিয়েছেন তার জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

কবরস্থানটি লিমরিক কেন্দ্রিক গড়ে উঠার সমুহ সম্ভাবনা থাকলেও আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত সকল মুসলিমদের ব্যবহারের জন্যই এটি উন্মুক্ত থাকবে। কাউন্সিল থেকে আমরা যে পরিমাণ অর্থ অনুদান পেয়েছি তা কবরস্থান নির্মানের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই একটি পর্যায়ে মুসলিম কমিউনিটির সকলকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করেন জনাব তালুকদার। এ লক্ষ্যে সর্ব স্তরের মানুষ নিজ তাগিদে উদারতার সাথে এগিয়ে আসবেন বলেও তিনি বিশ্বাস করেন।

মুসলিমদের জন্য একটি আলাদা কবরস্থান নির্মানের দাবি বহুদিনের। আমরা যখন কমিউনিটি ভিত্তিক সামাজিক সংগঠন গঠন করেছিলাম তখনও এ দাবিটি ছিলো সর্বাগ্রে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমরা সফল হতে পারিনি। বহু দিন পর কাউন্সিলর আজাদ তালুকদারের বলিষ্ঠ প্রচেষ্টায় আজ তা বাস্তবায়নের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। আজাদের এ সাফল্য শুধু তাকেই মহিমান্বিত করেনি, গর্বিত করেছে পুরো বাঙ্গালিকে। তার এ অর্জন, এ গৌরব শুধু তার একার নয়, গোটা বাঙ্গালি জাতির।


সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
লেখক, প্রাবন্ধিক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট
ইমেইলঃ  এই ইমেইল ঠিকানাটি spambots থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। এটি দেখতে হলে আপনার জাভা স্ক্রিপ্ট সক্রিয় থাকতে হবে।
লিমরিক, আয়ারল্যান্ড

২২শে জুন, ২০২০