লেখালেখি করা হয় না অনেক দিন। লিখতে মন বসে না, সহজভাবে বললে বলা যায়, এখন আর আগের মতো লেখা আসে না। চেষ্টাও করি না। সময় পেলেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিই। এতে আমার স্ত্রী বিরক্ত হয়ে মাঝেমধ্যে কিছুটা খোঁচা দিয়েই বলেন, তুমি না লেখক-কবি ছিলে, কোথায় আজ তোমার লেখা; অনুভূতি বুঝি ভোঁতা হয়ে গেছে!
সত্যিই অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে। কী-ই বা পাওয়া যায় লেখালেখি করে। নব্বই থেকে আটান্নব্বই সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকে আমার লেখা গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ছাপা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার পরও এসব লেখালেখি আমাকে নিজ দেশে সুন্দর-সাবলীলভাবে জীবন-যাপনের ন্যুনতম গ্যারান্টি দিতে পারেনি। তাই সব শেষে ইনকিলাবে একটি অভিমানী কবিতা লিখে ফ্লাই করি সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে।
'লেখালেখি' নামক বস্তুটি আমার হৃদয় থেকে যখন উবে যেতে শুরু করলো, তখনি দেখি সিঙ্গাপুর থেকে 'প্রবাসী' নামের একটি মাসিক পত্রিকা বেরুচ্ছে। অল্পশিক্ষিত কন্সট্রাকশন কর্মী কান্তু ভাইয়ের অনুরোধকে উপেক্ষা করতে না পেরে লিখলাম তাদের ওয়ার্ক পারমিটজনিত কিছু সমস্যা এবং সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্তব্যকাজে অবহেলা-অপারগতা নিয়ে। জানি না, ওই লেখা তাদের জন্য কোনো ফল বয়ে এনেছিল কি-না। তবে এতোটুকু জানতে পেরেছি, লেখাটি প্রকাশ হওয়ার কিছুদিন পর তৎকালীন অ্যাম্বেসেডর আশরাফ সাহেব বদলি হয়েছিলেন। এরপর অবশ্য কিছুদিন লিখি সেখানে সম্পাদক সাহেবের অনুরোধ ও বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাবের জন্য।
হুট করে ফুফাতো ভাই জহিরের উদার প্রচেষ্টায় চলে এলাম ইউরোপ তথা শান্তিপ্রিয় দেশ আয়ারল্যান্ডে। আবারো হারিয়ে গেলাম লেখালেখির জগৎ থেকে। একদম লিখি না। সহসা একদিন এক বন্ধুর প্রতি বন্ধুপত্নীর আচরণ আমাকে ভাবিয়ে তোলে। ঘরের কম্পিউটার, টিভি ভেঙে, স্বামীকে অশ্লীল ভাষায় গালাগালের মাধ্যমে যদি স্বামীর কোনো ভুলের প্রতিশোধ নেওয়া হয় কিংবা এ-ই যদি স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার সংসারের রূপরেখা হয়, তাহলে কতোটুকুই বা সার্থকতা থাকে এ সংসার পাতার। ঘটনাটি আমাকে যাতনা দেয়। আর এ মর্মযাতনা থেকেই জন্ম হয় একটি গল্পের, যা দু হাজার পাঁচ কিংবা ছ-এ প্রকাশ পায় একটি জাতীয় দৈনিকে। এরপর থেকে অদ্যাবধি দুএকটি ছড়া ছাড়া আর কিছুই লিখিনি। লিখতে পারিনি। আজ কেন জানি আবারো ইচ্ছে হলো কিছু লিখতে আয়ারল্যান্ডস্থ আমাদের বাঙালি কমিউনিটি নিয়ে।
প্রিয় পাঠক, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি মূল বিষয় থেকে সরে গিয়ে নিজের ফিরিস্তি টেনে লেখাটিকে বড় করার জন্য।
আয়ারল্যান্ডে আমি যে এলাকায় বাস করি তার নাম লিমরিক। এটি হচ্ছে একটি কাউন্টি, যা কিনা বাংলাদেশের একটি জেলার সমপর্যায়ের। এ কাউন্টিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত লোকের সংখ্যা হবে তিন থেকে চার শ। এর মধ্যে কেউ ছাত্র, কেউ চাকুরে। প্রত্যেককেই ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয় নিজ কাজকর্ম নিয়ে। মাঝেমধ্যে বউ, ছেলেমেয়েকে সময় দেওয়াটাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ কঠিনতর পরিবেশ বা পরিস্থিতির মধ্যেও নিজ দেশের কালচার, ভ্রাতৃত্ববোধ বা ধর্মীয় মূল্যবোধকে ইউরোপেও যাতে লালন করা কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বীজ বপন করিয়ে দেওয়া যায়, এর জন্য যে সময় বা আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন তা করতে কিন্তু অধিকাংশ লোকই কৃপণতা করেন না। তাহলে সমস্যা কোথায়?
যখন আমরা কমিউনিটির নামে কোনো সংগঠন বা কমিটি তৈরি করি তখনই যতো সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মনমতো কেউ পদ না পেলে, যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য পদ দিতে না পারলে কিংবা যখন সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বা ঘুমে রেখে 'নেতা' নামধারীরা কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে নিজেদের মনমতো কাজ করে ফেলেন, তখনি সে কমিউনিটি বা সংগঠনে ফাটল ধরে, নামে ধস। আমাদের লিমরিক-ভিত্তিক যে কমিউনিটি আছে তাও কিন্তু এ সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। এখানে এগুলোর পাশাপাশি আছে 'ইজম' সমস্যা। উপরোক্ত সমস্যা আর 'ইজম' ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কতিপয় লোক মূল কমিউনিটি থেকে সরে গিয়ে আরেকটি পক্ষ বা দল তৈরি করেছে, যার অশুভ প্রভাব সামাজিকভাবে পড়ছে আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মের ওপর।
ঐক্য সম্প্রীতি বাড়ায়, আনে প্রগতি। এই ইতিবাচক উপলব্ধি থেকেই আমরা একই ধারার অভিন্ন স্রোতে মেশার তাগাদা অনুভব করলাম। যার ফল হিসেবে আমরা উভয়পক্ষ থেকে পাঁচজন করে প্রতিনিধি নিয়ে স্থানীয় প্যাট্টিক পাঞ্চ হোটেলে বসলাম সমঝোতার আলোচনার জন্যে। কটুক্তি, নেতিবাচকতা ও ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণাত্মক কথাবার্তার পরে আলোচনা যখন প্রায় সফলতার শেষ পর্যায়ে ঠিক তখনি দু-একজন উগ্র বিপথগামীর আচরণের জন্য উত্তপ্ত হয়ে উঠে সন্ধ্যার পরিবেশ। বিদ্রূপের হাসি হাসার সুযোগ পেল স্থানীয় শ্বেতচর্মধারী মানুষগুলো। হোটেল কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারলো, আমরা আর কিছুই নই, যেনো শুধুই বাঙালি।
সত্যিকার অর্থে এরকম সমস্যা শুধু লিমরিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কর্ক, কিলারনি, ওয়াটারফোর্ড, কিলকেনী, ডাবলিন, গলওয়ে ইত্যাদি কাউন্টি তথা সমস্ত আয়ারল্যান্ডের বাঙালি কমিউনিটিগুলো এ দুষ্টু রোগে ভুগছে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। দু-চার বছর আগে যখন আমরা বাঙালিরা ঠিকমতো কেউ কাউকে চিনতাম না, কিংবা এখানকার মতো সমস্ত আয়ারল্যান্ডের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে একে অন্যের সাথে লিয়াজোঁ তৈরি করার সক্ষমতা ছিল না; তখন কোনো এক কাউন্টির ভদ্রলোক 'বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব আয়ারল্যান্ড' নামে একটি সংগঠন করেন, যা কিনা ডাবলিনে বসবাসরত কিছুসংখ্যক লোক ছাড়া অন্যান্য কাউন্টির সব বাঙালির কাছেই ছিল অজ্ঞাত। আর এখানেই সমস্যা। তিনি যেহেতু সংগঠনটির নামকরণ করেছেন পুরো আয়ারল্যান্ড-কেন্দ্রিক, সেহেতু তাঁর উচিত ছিলো অন্তত প্রতিটি কাউন্টির দু-একজন প্রতিনিধির কাছে এ ম্যাসেজ পৌঁছে দেওয়া। এ গ্লোবালাইজেশনের যুগে এটি কোনো কঠিন কাজ ছিল না। লন্ডনে অবস্থানরত যে কোনো বাঙালি টিভি চ্যানেলে এ বিষয়ে একটি বিজ্ঞাপন দিলেই হতো। এতে তাঁর উদারতা ও মহত্ত্বেও পরিচয় পাওয়া যেত।
সময়ের প্রেক্ষাপটে পরে যখন এ ঘটনা সবার কাছে জানাজানি হলো, এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুললেন। সবার মনেই প্রশ্ন দেখা দিলো, একটি কাউন্টিভিত্তিক সংগঠন তো পুরো আয়ারল্যান্ডের নাম বহন করতে পারে না। এটি অন্যায় ও বিধিবহির্ভূত।
এর সুরাহা বা সঠিক সমাধানের জন্য অর্থাৎ সংগঠনটির কার্যক্রমকে শক্তিশালী করা অথবা সবার কাছে এটাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য আয়ারল্যান্ডের সব কাউন্টি থেকে আগত প্রতিনিধি ও সদস্যদের নিয়ে লিমরিকের সাউথ কোর্ট হোটেলে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হলো। আলোচনা বক্তব্যের পাশাপাশি এক পর্যায়ে উত্তপ্ত পরিবেশে প্রায় হাতাহাতিতে রূপ নিলো। এর নাম যদি সংগঠন বা কমিউনিটি হয়; এর নাম যদি পারস্পরিক বন্ধন, কল্যাণ, ভ্রাতৃত্ববোধ বা সম্পর্কোন্নয়নের পাথেয় হয়, তাহলে নিকুচি করি এ সংগঠনের, নিকুচি করি এ কমিউনিটির।
কেন কমিউনিটি বা সংগঠন তা কম-বেশি আমরা সবাই জানি। কমিউনিটি শুধু সাধারণ নিরপেক্ষ লোককে পুঁজি করে সভাপতি-সেক্রেটারি বা নেতা হওয়া নয়। নেতৃত্বের টানাপোড়নে যেখানে একটি কমিউনিটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় সেটা কোনো সঠিক কমিউনিটি হতে পারে না। বিভাজিত কমিউনিটি কারো জন্যে কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
শুধু নির্বাচন দিয়ে নামসর্বস্ব সভাপতি-সেক্রেটারি হওয়া যাবে, একতাবদ্ধভাবে কাজ করা যাবে না। আর যখন কাজ করতে পারবেন না, তখনই সংগঠন ব্যর্থ হবে। সংগঠন বা কমিউনিটির কাছে নিরপেক্ষ মানুষের চাহিদা বহুমাত্রিক। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালিদের জন্যে তো বটেই। আমরা মূলত প্রবাসে বাস করলেও আমাদের সমাজব্যবস্থার আলোকেই এ দেশের পরিবেশ-প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। নিজের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রবাসের মাটিতে লালন করা বা এর ভিতকে শক্তিশালী করা কোনো একক ব্যক্তির পরিশ্রমের ফসল হতে পারে না। যুগ যুগ ধরে সংঘবদ্ধভাবে প্রবাসীদের তা করে আসতে হচ্ছে। এ সংঘবদ্ধতাকে ত্বরান্বিত করছে দল, সংগঠন বা কমিউনিটি।
যে কোনো দল বা সংগঠনকে কিছু কিছু মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়। যেখানে শুধুই নেতৃত্বের টানাপোড়ন আর আদর্শ, বিশ্বাস, ঐক্য, ভাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি সেখানে তার ধস নামবেই। আমাদের এ আয়ারল্যান্ডেও ঘটছে ঠিক তাই। শুধু আয়ারল্যান্ড নয়, আমার ধারণা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাঙালিরা কেউ এই রাহু থেকে মুক্ত নয়।
আয়ারল্যান্ড প্রবাসী বাঙালিদের মৌলিক সমস্যা বলতে যা বুঝায় তা হলো বাংলাদেশের একটি দূতাবাস স্থাপনে সরকারকে তাগিদ দেওয়া, বাঙালি মুসলিমদের জন্য একটি কবরস্থানের ব্যবস্থা করা, স্থানীয়ভাবে মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে তোলা ইত্যাদি। আর অন্য যেসব কাজের কথা আমরা বলি বা করি, এগুলোতে প্রতিটি মানুষই মানবিক তাড়নায় তাড়িত হয়ে বিভিন্নভাবে যোগ্যতা বা ক্ষমতা অনুযায়ী সাপোর্ট করে থাকেন।
তাই বলব, শুধু সংগঠনের জন্য সংগঠন নয় কিংবা কর্তৃত্বের জন্য পদবি নয়। আসুন মৌলিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানে সক্রিয় সচেষ্ট হই। এজন্য প্রতিটি এলাকায় নতুন করে কমিটি তৈরি করি, যা অবশ্যই গতানুগতিক সভাপতি-সেক্রেটারি পদ্ধতির হবে না। তা হবে কাজভিত্তিক।
যিনি যে এলাকায় যে বিষয়ে কাজ করবেন তিনি সে এলাকার কমিটিতে সে বিষয়ক সম্পাদক হবেন। এসব কমিটিতে বিষয়ভিত্তিক সম্পাদক থাকতে পারেন। কজন সম্পাদক থাকবেন তা হতে পারে আলোচনা সাপেক্ষে।
তাই সব প্রবাসী বাঙালির কাছে আহ্বান, দ্বন্দ্ব-অভিমান-ক্ষোভ ভুলে নিজ আগ্রহ ও যোগ্যতা অনুসারে যে কোনো বিষয়ে সৃষ্টিশীল, সেবামূলক বা উৎপাদনমুখী কাজ শুরু করি এবং অন্যকেও উৎসাহিত করি। গতানুগতিক সভাপতি-সেক্রেটারিমার্কা কমিটি করার সিস্টেম বর্জন করি। পদ বা ক্ষমতার টানাপোড়নের বেড়াজাল থেকে নিজেদের মুক্ত করি। অন্যের সমালোচনা বাদ দিয়ে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকি।
গুহাযুগের ধাপ অতিক্রম করে সভ্য সমাজে পদার্পণ করেছে মানুষ। চাঁদ মুখর হয়েছে মানুষের পদযাত্রায়। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যাত্রা করছে মানুষ। তাই আসুন সবাই নজরুলের সাম্যবাদের পতাকাতলে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকে চমকে দিয়ে প্রমাণ করি, আমরা এখনো শুধু বাঙালিই থেকে যাইনি, মানুষও হতে পেরেছি।
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
ইমেইলঃ এই ইমেইল ঠিকানাটি spambots থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। এটি দেখতে হলে আপনার জাভা স্ক্রিপ্ট সক্রিয় থাকতে হবে।
লিমরিক, আয়ারল্যান্ড
১৬ই জুন, ২০২০