আজ থেকে ৫ বছর আগেও এতবেশি বাংলাদেশি ইউরোপ-আমেরিকায় ছিল না। বিদেশকে এখন আর অপরিচিত মনে হয় না। কারও মামার বাড়ি, কারও খালার বাড়ি। ইউরোপটাকে এখন এমনই মনে হয়। যার কেউ নাই তারও কোনও না কোনও আত্মীয় আছে। আমার নিজের কথাই বলি, আমি যখন দেশ ছাড়ব তার ৫ বছর আগে থেকেই আমার ভাই লন্ডন প্রবাসী।

হয়ত বিদেশ আসার কথা ছিল না, যেকোনোভাবেই হোক আমি নিজেও আজ প্রবাসী। যখন দেশ ছাড়ব, ভাই ফোন করে বললেন, সেতো বিদেশ আসছে না। সে শুধু বাসা পাল্টাচ্ছে। আসলেই তাই, সেদিন সবাইরই মন খারাপ কিন্তু কেউ দুচিন্তায় ছিল না।

এখানকে হয়ত বাংলাদেশের মতো মনে হবে না কিন্তু বাসে ট্রেনে রাস্তায় সবখানেই বাংলাদেশি পাওয়া যায়। আগে দেখতাম কেউ বিদেশে যাওয়ার সময় আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে, বন্ধু-বান্ধব সবাই জড়ো হয়, অনেককেই কান্নাকাটি করতে দেখতাম। চোখের জল ধরে রাখা অনেক কষ্টকর ছিল, বুঝতাম তাদের গভীর বেদনা। বহুদিন হল দেশ ছেড়েছি, এখন আর জানি না। এখন আর কান্নার কারণ আছে বলে মনে করি না। কারণ এখন বিদেশে আরেক বাংলাদেশ।

প্রায় নয় বছর আগের কথা, পর্তুগালে এক বন্ধু পোড়া মুরগী খাওয়াবে তাই প্রায় ৩০ মিনিট বাসে চড়ে হালাল মুরগীর সন্ধান পেলাম, যদিও জানি না মাংসটা কতটুকু হালাল। হয়ত বিশ্বাস হচ্ছে বড় ব্যপার। বিদেশে মাংস কিনলে বা আমরা কারও দাওয়াতে গেল, আগে জেনে নেই মাংসটা হালাল কিনা অথচ আমরা একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করি না বা চিন্তা করি না আমাদের বা তাদের আয়টা হালাল কিনা।

এখানে অনেককে দেখেছি, দেশে ছেড়েও অনেক পরহেজগার, ৫ ওয়াক্ত নামাজসহ, ধমীয় সবই পালন করে। আবার এমনও দেখেছি, তিনি প্রচুর মদ খান, কিন্তু তিনি ম্যাকজোনাল্ডস, কেএপসিতে খান না, কারণ এসবের Meat বা মাংস হালাল না।

আমরা বাংলাদেশিরা এখানে ব্যবসা, চাকরিসহ প্রায় সব সেক্টরেই আছি। কিন্তু কিছু কিছু ব্যবসা বা চাকরিতে আমরা প্রবাসীরা অন্য চোখে দেখি। এনিয়ে বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকে শেয়ার করেছিলাম, মদ এবং শুকর দুটোই ইসলামে হারাম। ইউরোপের বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে মদ এবং শুকর বিক্রি হয়। রেস্টুরেন্ট ব্যবসা বা কাজ করলে কেউ কিছু বলে না। বারে শুধু মদ বিক্রি হয়। এই বারে কাজ বা ব্যবসা করলেই জনগণ অন্য চোখে দেখে। এ যেন রবী ঠাকুরেরে ছুটি গল্পের মতো, মাখন দোষ করলেও মা কিছু বলে না। সব দোষ ওই ফটিকের-ই।

বহুদিন হলো বিদেশে আছি, প্রিয় দেশকে অনেক অনেক মিস করি। আমারমত সবারই একই অবস্থা। আমরা সব প্রবাসীদের জীবন এই রকমই সবকিছু থেকেও যেন কোন কিছু নেই।

সমাজ মানুষকে একঘর করে। একঘরে মানে সমাজের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া। ওই সমাজে থেকেও সে চাইলেও সমাজের সাথে চলতে পারে না। প্রবাস জীবনকে মনে হয় অনেকটা অঘোষিত: একঘর: পরিবার, আত্মীয় কিংবা বন্ধুবান্ধবের সাথে হয়ত কথা বলা সম্ভব, কিন্তু আমান ভাইদের চায়ের দোকানে আর আড্ডা দেয়া যায় না।

এক এক সময় প্রবাস জীবন এক এক রকম হয়ে উঠে। বিভন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে দেশকে মনে পড়ে, সেদিন আটলান্টিকের পাড়ে বসে লিখেছিলাম, এখানে আটলান্টিককে অনেকটা নদীর মতো মনে হয়। যেদিন প্রথম জাহাজে এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে গেলাম, মনে হলো যেন ঢাকা মাওয়া -কাওরাকান্দি গেলাম। অসাধারণ এক অনুভূতি। মাঝে মাঝে সাগর পাড়ে আড্ডা দিতে আসি, বড়ই ভালো লাগে।

আজ একা এলাম, একলা মনে হয় না, জানি আমার মতো অনেকেই একা বসে আছে। কখনও মনে হয়, ধর্ম সাগর পাড়ে, আবার কখনো মনে হয় কলেজ ফাঁকি দিয়ে যেন চাঁদপুরের নদী ঘাটে বসে আছি। দেশকে অনেক অনেক মিস করি। ইদানিং যেখানেই যাই দেশের সাথে একটা মিল পাই, শিলাবৃষ্টির দিনে টিনের চালের উপর বৃষ্টির টুপটুপ শব্দ শুনতে পাই। অনেক বৃষ্টিতে মনে হয়, এখানেও বাংলার বর্ষা এলো।

শফিউল আলম
সুইডেন প্রবাসী