সোনার খাঁচার দিনগুলোকে খুব মনে পরে- যখন কারো মৃত্যু হলে পাড়া পড়শী, আত্বীয় স্বজনের আহাজারিতে ভারী হয়ে যেত পুরো পরিবেশ। কবর খোড়া থেকে শুরু করে দাফনের কাজ করতো চোখের জলের ভালবাসা দিয়ে।

মৃত বাড়ীতে খাবার আসতো প্রতিনিয়ত। কার আগে কে খাবার নিয়ে আসবে, তা নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। এক করোনায় হারিয়ে যেতে বসেছে মনের জল আর চোখের নোনা জলের সেই সোনালী মায়াভরা দিনগুলো।

যে ভাইরাসটি নিয়ে মানুষের মাঝে মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে প্রিয় মানুষদের, এমনকি মৃত্যুর পরে কবরে মাটি দিতেও অনীহা! আসলেই কি ততটা শক্তিশালী করোনা? করোনা মূলতঃ বেশী ছড়ায় হাত দ্বারা, এরপরে নাক, মুখ চোখ দিয়ে প্রবেশ করে। আক্রান্ত ব্যাক্তির হাঁচি, জোরে জোরে নিশ্বাস থেকেও আরেকজন আক্রান্ত হতে পারেন।

প্রশ্ন হলো আক্রান্ত ব্যাক্তির মৃতের পরে এ ভাইরাসটি কিভাবে ছড়াতে পারে বা তা থেকে কিভাবে প্রতিরোধ সম্ভব। মৃত্যুর ৭-৮ ঘন্টা পরে এ ভাইরাসটি দূর্বল হয়ে যায়, যেহেতু মৃত ব্যাক্তির শ্বাস প্রশাস ও হাঁচি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাকে দিয়ে ছড়ানোর কোন শঙ্কা থাকেনা, শুধু তার শরীরে লেগে থাকা ভাইরাসটি থেকে যায়, এটি- পিপিই ও গল্ভস্ পরে গোসল দিলেই মৃত ব্যাক্তির কাছ থেকে ভাইরাসটি ছড়ানোর কোন সম্ভাবনা থাকেনা।

সাধারনতঃ করোনায় ৮০-৮২% আক্রান্ত ব্যাক্তিদের চিকিৎসার দরকার হয়না, এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। ১৮-২০ চিকিৎসার দরকার হয়, এর ভিতর থেকে ৫-৭% যায় আইসিইউ তে। আইসিইউ থেকে ৩-৪% ফিরে আসেন সুস্থ হয়ে। বাকী ৩-৪% মানুষ মৃত্যু বরন করেন। আর বয়সের দিক থেকে যদি হিসেব করা হয় তাহলে যাদের শারীরিক সমস্যা আছে ৭০-৮০ বা ততোধিক বয়সের মানুষদের মৃত্যু ঝুঁকি সবচেয়ে বেশী। চল্লিশ বছর থেকে ৭০ পর্যন্ত নির্ভর করে তার শারীরিক অবস্থার উপর। আর ৪০ বছরের নীচের বয়সের বেলায় এ হার ০.৪%। এই ০.৪% মৃত্যু নিয়েই যত হৈ চৈ।

যেহেতু বিশ্বে এ ভাইরাসটি নতুন, ও প্রথম দিকে এটা প্রতিরোধে মানব জাতির প্রস্তুতিও ছিলনা, তাই মৃতের হার বেশী হয়েছে। দিন যতই যাচ্ছে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে এ হার নীচের দিকে যাচ্ছে, কারন- আমরা সচেতন হচ্ছি, জানতে পারছি প্রতিরোধের সকল ব্যাবস্থা। মৃত ব্যাক্তির দাফনে যতটা বেশী ভয় পায়, তারচেয়ে অনেক বেশী ভয় পাওয়া উচিত জীবিত মানুষদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা। এই ঈদেও মানুষ দল বেধে দেশের বাড়ীতে আসছেন, ঘুরছেন ইচ্ছেমত, খেয়েছেন দাওয়াত। অনেকেই সচেতন না হয়ে ইতিমধ্যে ছড়িয়েছেন এ ভাইরাস সবার মাঝে। আর এ কারনেই মৃতের হার বাড়ছে বাংলাদেশে।

যেখানে সবচেয়ে সতর্ক বেশী হওয়ার কথা, তা না করে মৃত ব্যাক্তির লাশ দাফন না করতে দেয়া, পরিবারটিকে বাঁকা চোখে দেখে সমাজ থেকে আলাদা করার হীন মানসিকতা আঁকড়ে ধরছে পুরো সমাজ ব্যাবস্থার উপর। এক করোনায় মানুষের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মমত্ববোধের দখিনের জানালা। যে মানুষগুলি সুস্থ থাকাকালীন পরিবার ও দেশের উন্নতিতে নিরলসভাবে নিজের শ্রম দিয়ে স্বচ্ছলতা এনে দিল, আজ এক ভাইরাসে মৃত্যুর পরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তার শেষ যাত্রার কফিনটুকু? মৃত্যুর পরে কর্পূর দেয়া হয় যেন শরীরের ঐ জায়গা তাড়াতাড়ি না পঁচে অথবা পোকামাকড় আক্রমন না করে। জীবিত মানুষগুলোর বিবেকের শরীরে পচন রোধে ভালবাসার কর্পূরের খুবই প্রয়োজন এ মহামারিতে। আসুন না একটু মানবিক হই। আর কয়টা দিন! আমাদের জন্য-ও অপেক্ষা করছে কর্পূর মাখা কোন দিন বা রাত!

সৈয়দ জুয়েল
সাংবাদিক, লেখক, প্রাবন্ধিক, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সময় টিভি প্রতিনিধি
গলওয়ে, আয়ারল্যান্ড