টিপাইমুখ ড্যাম বিষয়ক যৌথ সমীক্ষার নামে আবারো ন্যক্কারজনক ধোঁকা দিয়েছে ভারত। ৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, যৌথ সমীক্ষার জন্য বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দলকে সম্প্রতি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান প্রতিনিধি দলটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনে বাংলাদেশ পক্ষের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেন নেতৃত্ব দিয়েছেন। কথা নাকি ছিল সমীক্ষা দলটি টিপাইমুখ ড্যাম নির্মিত হলে বরাক অববাহিকার পানিসম্পদ, পরিবেশ, ভূমিকম্প, কৃষি, আর্থ-সামাজিক ও আবহাওয়াগত সম্ভাব্য পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরেজমিন সমীক্ষা চালাবে। টিপাইমুখ ড্যামের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে কি না, নাকি বাংলাদেশ সত্যি কোনোভাবে লাভবান হতে পারবে এসব বিষয়েও সমীক্ষা চালানোর এবং ভারতীয়দের সঙ্গে আলোচনা করার কথা ছিল। অন্যদিকে গঠিত হওয়ার প্রায় সাত মাস পর ২৬ থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত সমীক্ষা দলকে টিপাইমুখ এলাকায় দূরে থাকুক, নয়াদিল্লীর বাইরেই যেতে দেয়া হয়নি। নয়াদিল্লীতেও আবার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনেই টিম সদস্যদের ব্যস্ত রাখা হয়েছে। যে দু'চারটি বৈঠক ভারতীয়রা করেছেন সেগুলোতেও প্রতিনিধি দলের হাতে কোনো তথ্য-উপাত্ত তুলে দেয়া হয়নি। ভারতীয়রা শুধু বাংলাদেশের সম্ভাব্য লাভ ও উপকারের ব্যাপারে লেকচার শুনিয়েছেন। জ্ঞান দিয়েছেন। সে জ্ঞানের ‘বস্তা' কাঁধে নিয়েই ফিরে এসেছে বাংলাদেশের যৌথ সমীক্ষা দল। প্রত্যেক সদস্যকে হুকুম দেয়া হয়েছে, কেউ যেন এসব বিষয়ে বিশেষ করে সংবাদ মাধ্যমকে কিছু না জানান। কিছু জানানোর থাকলে তা জানাবেন টিমের প্রধান। তার সঙ্গেই সাংবাদিকদের যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এত কড়াকড়ি ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও থলের বেড়াল ঠিকই বেরিয়ে পড়েছে। অন্তত এটুকু জানা গেছে যে, যৌথ সমীক্ষা দলকে টিপাইমুখ ড্যামের ধারে কাছে পর্যন্ত যেতে দেয়া হয়নি। কাগজে-কলমেও তারা কোনো তথ্য-উপাত্ত পাননি। সহজ কথায়, যৌথ সমীক্ষার নামে তাদের দিল্লী ঘুরিয়ে আনা হয়েছে।

খবরের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন পর্যায়েও ভারতের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়েই কথা উঠেছে। কারণ, টিপাইমুখ ড্যাম সাধারণ কোনো বাঁধ বা পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প নয়। ড্যামটি নির্মিত হচ্ছে সিলেট জেলার পূর্ব সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার উজানে বরাক নদীর মুখে। নির্মিত ও চালু হলে টিপাইমুখ ড্যাম সুরমা ও কুশিয়ারার পাশাপাশি মেঘনার পানি প্রবাহকেও বাধাগ্রস্ত করবে। এর অশুভ প্রভাবে বৃহত্তর সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, শরীয়তপুর ও বরিশালসহ মেঘনা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় দ্রুত মরুকরণ ঘটবে। নৌপরিবহন অচল হয়ে পড়বে। তাছাড়া ভারতের হাতে পানি নিয়ন্ত্রণের একচেটিয়া ক্ষমতা থাকবে বলে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশ পানি পাবে না, অন্যদিকে বন্যার সময় বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের বিরাট এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। পরিণতিতে কৃষি ও শিল্প-বাণিজ্যের সকল খাতেই ঘটবে মহা বিপর্যয়। টাকার অংকে বছরে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এটা ২০০৯ সালের প্রথম দিককার হিসাব। সে সময় এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, টিপাইমুখ ড্যামের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের অন্তত তিন কোটি মানুষ তাদের ভিটে বাড়ি ও পেশা ছেড়ে অন্য অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হবে। বিশেষজ্ঞরা অন্য একটি ঝুঁকির কথাও তুলে ধরেছেন। ভৌগোলিকভাবে টিপাইমুখের অবস্থান অতি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় বা টেট্রনিক প্লেটে। ওই এলাকায় ১৯১৮ সালে ৭ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্পের আশংকা এখনো প্রবলভাবে রয়েছে। সাধারণ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই টিপাইমুখ ড্যাম ধসে পড়বে। আর ধসে পড়লে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লাসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা ২০ থেকে ২৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক আইন হলো, ভূমিকম্প প্রবণ কোনো এলাকায় বড় ড্যাম নির্মাণ করা যাবে না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক আইনে অবশ্য পালনীয় শর্ত হচ্ছে, কোনো পানি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে প্রকল্প সম্পর্কিত সকল তথ্য অন্য পক্ষকে জানাতে হবে। উভয় পক্ষকে আলোচনায় বসতে হবে, অন্য পক্ষের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু ভারত টিপাইমুখ ড্যামের ক্ষেত্রে চুক্তি লংঘন করেছে। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। টিপাইমুখ ড্যাম উচ্চতায় ১৬১ মিটার, লম্বায় ৩৯০ মিটার। ত্যুভাল নদীর সঙ্গমস্থলের ঠিক নিচে এই ড্যামের পানি ধারণ ক্ষমতা হবে ১৫ দশমিক নয় মিলিয়ন কিউবিক মিটার। অথচ আন্তর্জাতিক আইনে ১৫ মিটার বা তার বেশি উচ্চতার এবং তিন মিলিয়ন কিউবিক মিটারের বেশি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ড্যামকে বড় বা লার্জ ড্যাম হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে, এ ধরনের কোনো ড্যাম নির্মাণ করার আগে অবশ্যই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করতে হবে। তার অনুমতিও নিতে হবে। এক্ষেত্রেও ভারত সুস্পষ্টভাবেই আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করেছে। ভারতের পক্ষ থেকে এমনভাবে বোঝানো হচ্ছে যেন কেবলই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টিপাইমুখে সাময়িককালের জন্য কিছু পানি ধরে রাখা হবে। তারপর রিসাইক্লিং'র কাজ হয়ে গেলেই পানি ছেড়ে দেয়া হবে। ভারতের পক্ষ থেকেও সে সময় ‘কিছু সময়ের জন্য খানিকটা পানি' ধরে রাখার কথা শোনানো হয়েছিল। হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন বলেছিলেন, ‘কিছু সময়' পরই ধরে রাখা ওই ‘খানিকটা পানি' ছেড়ে দেয়া হবে। এতে নাকি বাংলাদেশের কোনো ক্ষতিই হবে না! বাংলাদেশকে ‘বিনামূল্যে' বিদ্যুৎ দেয়া হবে বলেও প্রলোভন দেখিয়েছেন ভারতীয়রা। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরাও বিভিন্ন উপলক্ষে ভারতীয়দের রেকর্ডই বাজিয়েছেন। অন্যদিকে টিপাইমুখ নির্মিত হচ্ছে ঠিক ফারাক্কার অনুকরণে। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে মনিপুর রাজ্যের ফুলেরতলে ব্যারাজ এবং সংযোগ খাল তৈরি করে ভারত তিন দশমিক এক লাখ হেক্টর জমিকে সেচের আওতায় আনবে। এর ফলে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি ফারাক্কার ক্ষয়ক্ষতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। তাছাড়া বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কলকাতা ও শিলচরের মধ্যে নৌ চলাচলের পথও নির্মাণ করা হবে। কিন্তু এসবের সবই গোপন করেছে ভারত। উল্লেখ্য, ফারাক্কার ক্ষেত্রে ভারত ১৯৫১ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত অসত্য বলেছে। টিপাইমুখ সম্পর্কেও ১৯৭৯ ও ১৯৮৩ সাল থেকে মিথ্যাই বলে আসছে ভারত।

ভারতের এই নতুন পর্যায়ের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল এবং নদী বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছেন। কিন্তু কর্তব্য যেখানে ছিল দেশপ্রেমিকদের প্রতিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কেউ সেখানে উল্টো সাফাইও গেয়েছেন। এর প্রমাণ প্রথমে দিয়েছেন ভারতের কাছ থেকে ‘কিছু পরিমাণ' পানি পাওয়ার আশ্বাসে কৃতার্থ হয়ে যাওয়া পানি সম্পদমন্ত্রী। ইন্টারনেটসহ তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে সারা পৃথিবী জানলেও মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন বলেছেন, টিপাইমুখ ড্যাম সম্পর্কে তিনি নাকি কিছুই জানেন না! অন্য একটি কথা শুনিয়েও একেবারে ‘তাক' লাগিয়ে দিয়েছিলেন মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন। বলেছিলেন, ভারত আগে টিপাইমুখ ড্যাম চালু করুক। তারপর ড্যামের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের কি ধরনের ও কি পরিমাণের ক্ষয়ক্ষতি হয় সেসব দেখার পর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে, ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানানো হবে কি না। এ পর্যন্ত বলেও থেমে যাননি মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন। ভয় দেখানোর সুরে বলেছেন, ভারত একটি বড় দেশ। ভারতকে ক্ষেপিয়ে আমরা কোনো সুবিধা করতে পারব না! এটা ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসের কথা। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, শেষ কথাটার মধ্য দিয়ে মন্ত্রী কিন্তু টিপাইমুখ ড্যাম চালু করার ব্যাপারে ভারতকে বাংলাদেশের ‘এনওসি' বা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, তাদের সম্মতির কথাও জানিয়েছিলেন। ওদিকে কোনো কোনো মন্ত্রী আবার টিপাইমুখ ড্যাম প্রসঙ্গে রীতিমতো ‘ফোঁস' করেও উঠেছিলেন। যেমন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান বলেছিলেন, টিপাইমুখ ড্যামের যারা বিরোধিতা করছেন তারা ড্যাম সম্পর্কে ‘কিছুই জানেন না'! অন্যদিকে সত্য হলো, যারা প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই ফারুক খানের মতো মন্ত্রীদের ড্যাম সম্পর্কে হাতে-কলমে শিখিয়ে-পড়িয়ে দেয়ার যোগ্যতা রাখেন।

পর্যালোচনায় অবশ্য প্রমাণিত হয়েছে, দোষ ফারুক খান বা রমেশ চন্দ্র সেনের ছিল না। তাদের যা শেখানো হয়েছিল তারা শুধু সেসব কথাই উগড়ে দিয়েছিলেন মাত্র। এ ব্যাপারে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে চলেছে আওয়ামী লীগ সরকার। শুরু থেকে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রাখলেও একে ওকে দিয়ে বলানোর মাধ্যমে সরকার আসলে জনগণের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছে। এই কৌশলের পাশাপাশি ছিল সময় ক্ষেপণের উদ্দেশ্যও। এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে জানা গেছে চলতি বছরের মার্চ মাসে। প্রকাশ্যে না বললেও সরকার সে সময় গোপনে ভারতকে সম্মতি জানিয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর বেরিয়ে পড়েছিল। এ সম্পর্কে প্রথমে জানান দিয়েছিলেন ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, টিপাইমুখ ড্যাম নির্মিত হলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে! এর পরদিন মনিপুর রাজ্যের ইংরেজি দৈনিক ‘দি ইম্ফল ফ্রি প্রেস' এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছিল, ভারত সরকার নাকি টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণের প্রশ্নে বাংলাদেশকে সম্মত করাতে পেরেছে। নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের হাই কমিশনারকে দিয়ে সে সময় এই সম্মতির কথা নাকি ঢাকা কথা আওয়ামী লীগ সরকার জানিয়ে দিয়েছিল। সম্মতি জানানোর ব্যাপারে সর্বশেষ ভূমিকাটুকু পালন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা গওহর রিজভী এবং মশিউর রহমান। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এই দু'জন উপদেষ্টা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এসব বৈঠকে ভারতীয়রা নাকি উল্টো টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণে বাংলাদেশকে বিনিয়োগ করতে বলেছিলেন। এর মাধ্যমে জনগণকে বোঝানো হবে, বিনিয়োগের কারণে যেহেতু মালিকানা স্বত্ব থাকবে সেহেতু ড্যামটি যাতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে নজর রাখার অধিকার থাকবে সরকারের। এসব শুনেই নৃত্য করে উঠেছিলেন গওহর-মশিউররা। তাদের পরামর্শে সরকারও ভারতকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিল।

এখানে সমীক্ষার নামে অন্য একটি হাওয়াই সফরের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। পাঠকদেরও মনে পড়তে পারে, সাবেক পানি সম্পদমন্ত্রী ও ৩০ বছর মেয়াদী পানি চুক্তির প্রধান রূপকার আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে সফরটি সম্পন্ন হয়েছিল। এটা ২০০৯ সালের ৩১ জুলাই ও ১ আগস্টের কথা। সেবারো দেশের মুখে সোজা চুনকালি মেখে একেবারে খালি হাতে ফিরে এসেছিলেন আবদুর রাজ্জাকরা। ভারতের বিমান ও হেলিকপ্টারে চড়ে হাওয়াই সফর করার বাইরে কিছুই করতে পারেননি তারা। প্রকল্পের স্থান দেখা দূরে থাক, তারা এমনকি নামতেও পারেননি টিপাইমুখের আশেপাশে। কারণ, দু'দিনই মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল ওই এলাকায়। ফলে আসামের রাজধানী গৌহাটি থেকে ঘণ্টা চারেক ধরে হেলিকপ্টারে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কিছুই করতে পারেননি আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। তারা দিল্লী ফিরে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই একেবারে খালি হাতে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন। ব্যর্থতার কথাটা অবশ্য সহজে স্বীকার করতে চাননি তারা। কারণ, ভারত প্রকল্প করছে মণিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে ও ফুলেরতলে। এটা বাংলাদেশের কাছাকাছি একটি এলাকা, যেখানে সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু আবদুর রাজ্জাকরা বিমানে উড়ে গিয়েছিলেন ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে। তাদেরকে দু'দিন ধরে ব্রিফিংও দেয়া হয়েছিল নয়াদিল্লীতেই যাকে অনেকে ‘কানপড়া' বলেছিলেন। নয়াদিল্লী থেকে তারা ‘হাওয়াই সফরে' এসেছিলেন আসামের রাজধানী গৌহাটিতে। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে রাজকীয় স্টাইলে গেছেন টিপাইমুখ দেখতে কিন্তু আবহাওয়া তাদের কিছুই দেখতে দেয়নি। তা সত্ত্বেও আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, বৃষ্টি ও কালো মেঘের ফাঁক দিয়েও তিনি নাকি দেখতে পেয়েছেন, সেখানে এখনো কোনো স্থাপনা তৈরি করা হয়নি। কোনো নির্মাণ কাজও চলছে বলে তার চোখে ধরা পড়েনি। প্রশ্ন উঠেছিল, এত প্রচন্ড বৃষ্টি ও কালো মেঘের মধ্যে হেলিকপ্টারে বসে উড়ন্ত অবস্থায়ও তিনি সব কিছু দেখতে পেয়েছিলেন কিভাবে? তাদের তো পাহাড় ও নদী ছাড়া কিছুই দেখতে পাওয়ার কথা নয়!

আসলেও পাহাড় ও নদী দেখেই ফিরেছিলেন আবদুর রাজ্জাকরা তাও সরাসরি নয়, ফেরার আগে তাদেরকে আরো একবার দিল্লী যেতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও আবদুর রাজ্জাক ভাষার মারপ্যাঁচ খাটানোর কসরত করেছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদ্যুৎমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, ভারত নাকি বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না সেখানে। কথার পিঠে কথাও যথেষ্টই উঠেছিল কারণ, এ ধরনের আশ্বাস প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আগেই দিয়েছিলেন। তাই যদি সত্য হবে তাহলে একই আশ্বাস শোনার জন্য আবার কেন ঢাকঢোল পিটিয়ে একটি প্রতিনিধি দলকে পাঠানো হয়েছিল? এখানেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন তথ্যাভিজ্ঞরা। তাদের অভিমত ছিল, বিষয়টি আদৌ এতটা সহজ-সরল নয়। হলে মনমোহন সিংয়ের আশ্বাসকেই যথেষ্ট মনে করা হতো। অন্যদিকে জনগণের মধ্যে বিরোধিতা ছিল বলেই সংসদীয় প্রতিনিধি দলের নামে আওয়ামী শিবিরের পরীক্ষিত ভারতপন্থীদের পাঠানোরই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রকাশ্যে প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন করা হলেও অন্তরালে কিছু বিশেষ বিষয় ও উদ্দেশ্যও ছিল। কথাও উঠেছিল সেগুলো নিয়েই। এ শুধু নিছক অনুমান নয়, বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত খবরেও জানা গেছে, বাংলাদেশে টিপাইমুখ ড্যাম বিরোধী আন্দোলনের প্রচন্ডতা দেখে ভারতকে কৌশল পরিবর্তন করতে হয়েছিল। দেশটিতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ‘বন্ধুপ্রতীম' সরকার তখনই আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চায়নি। কারণ, এই সরকারের কাছ থেকে ভারতের বহু কিছু আদায় করার রয়েছে। সে কারণেই ভারত সংসদীয় প্রতিনিধি দলের জন্য প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন করেছিল যাতে আওয়ামী লীগ সরকার জনগণকে বলতে পারে যে, টিপাইমুখ ড্যামের বিরুদ্ধে তারাও চেষ্টা করেছে। এর ফলে আওয়ামী লীগ সরকার কৃতিত্ব দেখানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। জনগণ বিশ্বাস করবে, সরকার আসলেও দেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় না। আর সে অবস্থার সুযোগ নিয়েই ভারত একের পর এক নিজের বিভিন্ন ইচ্ছা পূরণ করে নেবে। যেমনটি দেখা যাচ্ছে করিডোরসহ বিভিন্ন বিষয়ে।

মূলত সে কৌশলের ভিত্তিতেই ভারত এখনো এগিয়ে চলেছে। আওয়ামী লীগ সরকারও যথার্থ সেবাদাসের ভূমিকা পালন করে চলেছে। এজন্যই ভারত এমনকি যৌথ সমীক্ষা দলকে পর্যন্ত টিপাইমুখ এলাকায় যেতে দেয়নি। সেবার আবদুর রাজ্জাকরা তবু হাওয়াই সফরের সুযোগ পেয়েছিলেন, এবারের টিম সদস্যদের দিল্লির বাইরেই যেতে দেয়া হয়নি। আমরা মনে করি, বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নেয়ার পরিণতি দেশ ও জাতির জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠবে। ভারতকে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ থেকে নিবৃত্ত রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করা দরকার। কারণ, জাতিসংঘের নদ-নদীর পানি সংক্রান্ত কনভেনশনের আইনে বলা হয়েছে, উজানের কোনো দেশ ভাটির কোনো দেশকে পানি বঞ্চিত করতে পারবে না। জাতিসংঘের সহযোগিতা না পাওয়া গেলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে। স্পেন, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়াসহ অনেক দেশই আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে পানি সমস্যার সমাধান পেয়েছে। চেনাব নদীর পানির হিস্যা কম দেয়ায় পাকিস্তান মামলার হুমকি দিয়ে ভারতের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করেছে। ফারাক্কা বাঁধের ইতিহাস থেকেও বাংলাদেশের শিক্ষণীয় রয়েছে। বাঁধটি ভারত নির্মাণ করেছিল ১৯৫০'র দশকে। কিন্তু পাকিস্তানের তীব্র বিরোধিতা ও কঠোর অবস্থানের কারণে পাকিস্তান যুগে ভারতের পক্ষে ফারাক্কা বাঁধ চালু করা সম্ভব হয়নি। ভারত অনুমতি পেয়েছিল প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে। এ থেকেও পরিষ্কার হয়েছে, বাংলাদেশ যদি কঠোর অবস্থান নিতে পারে তাহলে টিপাইমুখের মতো নতুন কোনো ড্যাম ভারত নির্মাণ করতে পারবে না। কারণ, আন্তর্জাতিক আইনে ভাটির দেশকে পানিপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করা অপরাধ। অন্যদিকে ভারত সে অপরাধই করতে যাচ্ছে। বড় কথা, আওয়ামী লীগ সরকারও পালন করছে সেবাদাসের ভূমিকা। এজন্যই টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ থেকে ভারতকে নিরস্ত করার ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে দেশপ্রেমিকদের।

অনলাইন ডেস্ক