আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের কান্ডারী হুমায়ূন আহমেদ আর নেই বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক হুমায়ূন আহমেদ চিরবিদায় নিয়েছেন। ক্যান্সার নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে তার। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং তার রুহের মাগফেরাত কামনা করেছেন। 

লেখকের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, ছোটভাই মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, বন্ধু মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে ড. মোমেনও মৃত্যুর সময় হাসপাতালে ছিলেন।

বৃহদান্ত্রে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর চিকিত্সার জন্য নিউ ইয়র্কে যান হুমায়ূন আহমেদ। দুই পর্বে মোট ১২টি কেমো থেরাপি নেওয়ার পর গত ১২ জুন বেলভ্যু হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের প্রধান ডা. জেইন এবং ক্যান্সার সার্জন জজ মিলারের নেতৃত্বে হুমায়ূন আহমেদের দেহে অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচারের পর ১৯ জুন বাসায় ফিরেছিলেন এই লেখক। স্ত্রী শাওনসহ সন্তানদের নিয়ে কুইন্সে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকছিলেন তিনি। বাসায় ফিরলেও অবস্থার অবনতি ঘটলে পুনরায় বেলভ্যু হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। ২১ জুন তার দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার হয়। এরপর গত কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। অস্ত্রোপচারের আগে পরিবার-আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে গত ১১ মে মাসে দেশে আসেন হুমায়ূন। দেশে ২০ দিন অবস্থানের পুরোটা সময় গাজীপুরে নিজের গড়া নুহাশ পল্লীতে কাটিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশে একটি আধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ও নিয়েছিলেন তিনি। আরো কিছু দিন বেচে থাকলে হয়ত তিনি তার এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে যেতে পারতেন।

জনপ্রিয় এই লেখক হুমায়ূন আহমেদের বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা জেলায় জন্ম হয়েছিল তার। হুমায়ূন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই লেখালেখি শুরু করে সাহিত্য সমালোচকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। নন্দিত নরকে তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। এরপর শঙ্খনীল কারাগার, রজনী, এপিটাফ, পাখি আমার একলা পাখি, ফেরা, নিষাদ, দারুচিনি দ্বীপ, নির্বাসন, অমানুষ, রূপালী দ্বীপ, শুভ্র, দূরে কোথাও, মন্দ্রসপ্তক, বাদশাহ নামদার, সাজঘর, বাসর, নৃপতির মতো পাঠক হৃদয় জয় করা উপন্যাস আসে তার লেখনীতে। বাঙালি পাঠককে তিনিই আবার উপন্যাস পড়ার অভ্যাসে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গেও তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। আর প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছেতো তার লেখা ছিল হাতের কাছে মাতৃভূমির জীবন্ত ছোয়া। এই মহান লেখকের লেখা পরেই বড় হয়েছে কয়েকটি প্রজন্ম যাদের মন ও মনন তৈরী হয়েছে তার তৈরী করা ভুবনে বিচরণ করে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি লিখেছেন জোত্সনা ও জননীর গল্প, ১৯৭১, সূর্যের দিনের মতো উপন্যাস। হুমায়ূনসৃষ্ট মিসির আলী ও হিমু হয়ে উঠে পাঠকদের প্রিয় চরিত্র। অনন্ত নক্ষত্র বীথি, ইরিনার মতো কয়েকটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনীও লিখেছেন তিনি। এসব কল্পবিজ্ঞান কাহিনীতে তার বিজ্ঞান সম্পর্কে অগাধ পান্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। হুমায়ূন তার প্রধানত সংলাপনির্ভর উপন্যাসমালায় মধ্যবিত্তের জীবনের নিস্পন্দ রোমান্টিকতাকে নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন বলে সাহিত্য সমালোচকদের মত। তার উপন্যাসের চরিত্র গুলোকে কখনো দুরের মনে হয়নি। এত কাছের মানুষগুলোর মধ্যেও যে এত অচেনা রহস্যময় বৈশিষ্ট লুকিয়ে থাকে হুমায়ুন আহমেদের লেখা না পড়লে তা বোধ করি আমাদের কখনো জানা হতনা।

তাকে নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, “হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থ শ্রেণীর লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।”

উপন্যাসের পর নাটক লেখায় হাত দেন হুমায়ূন। এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠায় অধ্যাপনা ছেড়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের এই শিক্ষক।

’৮০ এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘এইসব দিনরাত্রি’ দিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান তিনি। এরপর বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাতের মতো জনপ্রিয় নাটকও আসে তার হাত দিয়ে। কোথাও কেউ নেই-এর প্রধান চরিত্র বাকের ভাই-এর জনপ্রিয়তার সাথে তুলনা করা যায় এমন কোনো চরিত্র বাংলা টেলিভিশন নাটকের জগতে আজো তৈরী হয়নি। কোনো নাটকের চরিত্রের জন্য সাধারণ মানুষের রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল করার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই বললেই চলে। 

নাটক লেখার এক পর্যায়ে নির্দেশনায়ও নামেন হুমায়ূন। নাটক নির্দেশনায় হাত পাকিয়ে নামেন চলচ্চিত্র পরিচালনায়। আগুনের পরশমনি দিয়ে শুরু করে শ্রাবণমেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামলছায়ার মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আগুনের পরশমনি কয়েকটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের কুতুবপুর গ্রামে নানা বাড়িতে হুমায়ূনের জন্ম, যার ডাকনাম কাজল। তার বাবা পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, মা আয়েশা ফয়েজ।

হুমায়ূন প্রথম বিয়ে করেন ১৯৭৩ সালে গুলতেকিনকে। তাদের চার সন্তান হলেন নোভা, শীলা, বিপাশা ও নুহাশ। ২০০৫ সালে গুলতেকিনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর বিয়ে করেন শাওনকে। এই দম্পতির দুই সন্তান নিষাদ ও নিনীত।

এ, কে, আজাদ – বার্তা সম্পাদক