হিন্দি সিনেমা “গুন্ডে” ও বাংলাদেশের ইতিহাস
- Details
- Hits: 3343
যাকির হাসান:
‘গুন্ডে’ একটা হিন্দি সিনেমা। এটি ইতিহাসের বই নয়। বাংলাদেশের কিছু ব্লগার এটি নিয়ে অনেক লেখালেখি শুরু করেছে। ইতিহাস নিয়ে নিজের মত করে চিন্তা করা দোষের কিছু নয়।
পরিসংখ্যানটা ইচ্ছা মত দেয়াও দোষের কিছু নয়। তবে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ না হলেও, তা বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস হবে না। কারো ইতিহাস জ্ঞান কম থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে তাদের এ বিষয়ে বেশি না লেখাই ভাল।
আমি যা বলতে চাইছি তা হল ‘গুন্ডে’ সিনেমায় বর্ণিত ইতিহাসের সাথে আমি ভিন্নমত পোষণ করতে পারছি না। দু’ সপ্তাহের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ বাংলাদেশের জন্ম। পাকিস্তানের নব্বই হাজার সৈন্য ভারতীয় সেনা কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। পরবর্তীকালে তারা ভারতে কারাবরণ শেষে পাকিস্তানে ফেরত যায়। তাই এটা ভারতীয়দের কাছে পাক-ভারত তৃতীয় যুদ্ধই তো হবে। আর আমাদের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ । তুলনা স্বরূপ বলা যায় যে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিসাবে যা জানি, তা ব্রিটেনবাসীর কাছে ব্রিটিশ-জার্মান যুদ্ধ বলে মনে হতে পারে।
হাঁ, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে। অসংখ্য নারী ধর্ষিতা হয়েছে। সবই ঠিক। তবে এ কথাও ঠিক যে ভারত হস্তক্ষেপ না করলে ফলাফল ভিন্ন হলেও হতে পারত। তাই ইতিহাসকে কেবলই চেতনাজীবিদের কথিত চেতনার আলোকে সাজানো সঠিক বলে মনে করি না। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস আর কথিত চেতনা তো এক জিনিস নয়। ‘গুন্ডে’ সিনেমা কল্পকাহিনী ভিত্তিক হলেও ইতিহাসকে ভারতের পারস্পেক্টিভ থেকে সঠিকভাবেই তুলে ধরেছে। আমাদের চেতনাজীবিদের মনের মাধুরী দিয়ে সাজানো ইতিহাসের সাথে তা মেলেনি বলে চেতনাজীবিদের আঁতে খুব ঘা লেগেছে। এই কাজটি পাকিস্তানীরা করলে চেতনাজীবিরা এতো মনঃক্ষুন্ন হত না। কথিত মিত্রবাহিনীর দেশ ভারত কি করে এমন ইতিহাস তাদের সিনেমায় তুলে ধরল? আর তাতেই চেতনাজীবিরা বড় দুঃখ পেয়েছে!
আজকাল ব্লগাররা প্রচুর লেখালেখি করছে। তাতে জ্ঞানের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন না হোক, লেখার অভ্যাসটা বেশ বাড়ছে। তা ভাল বই কি। কিন্তু শাহবাগের চেতনা – যা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিকে সামনে নিয়ে এল, শুধু সেটাই কীভাবে হয়ে গেল স্বাধীনতার একমাত্র কথিত চেতনা? আমরা বুঝতে পারি না।
পাকিস্তান পার্লামেন্টে গৃহীত এক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে শাহবাগীরা প্রতিবাদ করল। পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করতে রওনা হল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নড়ে চড়ে বসলো। তারপর জনগণকে পাকিস্তানী পণ্য বর্জনের আহ্বান জানালো। অবশ্য দুষ্টজনে বলে যে বাণিজ্য মেলায় পাকিস্তানি পণ্য নাকি বিক্রি হয়েছে ইরানী স্টলে। আর পাকিস্তানী থ্রী পিছ গুলো কিনেছে আর কেউ নয় – কথিত চেতনাধারি বড় বড় টিপ পরা সেকুলার বাঙালি ললনারাই।
হিন্দি সিনেমা ‘গুন্ডে’ বর্ণিত কাহিনীর কিয়দংশ কথিত চেতনাধারিদের মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, যা লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, লক্ষ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে – তাকে কিনা বলছে তৃতীয় পাক-ভারত যুদ্ধ? চেতনাধারিদের কেউ কেউ এর তীব্র প্রতিবাদ করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে যথাযথ পদক্ষেপ নেবার জন্য। তবে কথিত চেতনাধারিদের মুখপাত্র শাহবাগ এ বিষয়ে একেবারে নীরব রয়েছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়াটা বোধকরি চেতনা পরিপন্থি কাজ হয়ে যাবে। তাই হয়ত এই নীরবতা। সেই সাথে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নিয়ামক হিসাবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকাকে মেনে নেয়ার মত কঠিন ও অবমাননাকর উপলব্ধি। এতে নিজেদের লজ্জা যেমন উন্মোচিত হয়ে ওঠে, তেমনি কথিত ভারতীয় বন্ধুরাও আসল চেহারা বের হয়ে যাওয়ায় বিব্রত হতে পারে। আর সর্বোপরি শাহবাগে বসে পুলিশ প্রহরায় ফ্রি বিরিয়ানি খাওয়াটাও তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শাহবাগীরা এত রিস্ক কেন নেবে?
কথিত চেতনাধারিরা দেশটাকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যায় – তা বেশ ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহুরে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী – বিশেষত এর তরুণ প্রজন্ম – একটা শূন্যতাবোধের মধ্য দিয়ে এই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই ব্যাধির একমাত্র সমাধান হতে পারে জ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে নিজের বিচারবোধকে স্বাধীন করে তোলা। তার জন্য আমাদের জানতে হবে ধর্ম, ইতিহাস ও সংস্কৃতি। জাতীয় নেতাদের জীবনী ব্যাপকভাবে পাঠ করতে হবে। শাহ জালাল থেকে জিয়াউর রহমান। সবাইকে পড়তে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে নয়। শহীদ তিতুমির, লালন শাহ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী নজরুল ইসলাম,বেগম রোকেয়া, মওলানা ভাসানি, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। তবেই স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে।
তথ্যসূত্রঃ sheikhnews.com